পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ভারতী মাথা নাড়িয়া বলিল, না সে তো অন্যায়, মিথ্যে জরিমানা, এ টাকা আমি বাধ দেব না।

 অপূর্ব্ব আশ্চর্য্য হইয়া কহিল, কি বিপদ! জরিমানা করাটা মিথ্যে হতে পারে, কিন্তু আমার টাকা দেওয়াটা ত মিথ্যে নয়।

 ভারতী কহিল, দিলেন কেন? ও টাকা আমি বাদ দেব না। দু’শ আশি টাকা চুরি গেছে।

 অপূর্ব্ব বলিল, না দু’শ ষাট টাকা।

 ভারতী বলিল, না, দু’শ আশি টাকা।

 অপূর্ব্ব আর তর্ক করিল না। এই মেয়েটির প্রখর বুদ্ধি ও সকল দিকে অদ্ভূত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখিয়া সে আশ্চর্য্য হইয়া গিয়াছিল; অথচ, এই সোজা বিষয়টা না বুঝিবার দিকে তাহার জিদ দেখিয়া তাহার বিস্ময়ের পরিসীমা রহিল না। বিচারের ন্যায় অন্যায় যাহাই হৌক, টাকা ব্যয় হইলে সে যে আর হাতে থাকে না এ কথা যে বুঝিতে চাহে না তাহাকে সে আর কি বলিবে?

 ভারতী অবশিষ্ট কাপড়গুলি গোছ করিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। অপূর্ব্ব জিজ্ঞাসা করিল, পুলিশে খবর দেওয়া কি আপনি উচিত মনে করেন?

 ভারতী মাথা নাড়িয়া কহিল, তা বটে। উচিত শুধু এই দিক থেকে হতে পারে যে তাতে আমার টানাটানির আর অন্ত থাকবে না। নইলে, তারা এসে আপনার টাকার কিনারা করে দিয়ে যাবে এ আশা বোধ হয় করেন না?

 অপূর্ব্ব চুপ করিয়া রহিল। ভারতী রলিল, ক্ষতি যা হবার হয়েছে, এর পরে আবার তারা এলে অপমান শুরু হবে।

 কিন্তু আইন আছে—

 অপূর্ব্বর কথা শেষ হইল না, ভারতী অসহিষ্ণু হইয়া উঠিল; বলিল, আইন থাকে থাক; এ আপনাকে আমি কিছুতে করতে দিতে পারবো না। আইন সেদিনও ছিল আপনি যেদিন জরিমানা দিয়ে এসেছিলেন। এর মধ্যেই তা ভুলে গেছেন?

 অপূর্ব্ব কহিল, লোকে যদি মিথ্যে বলে, মিথ্যে যামলা সাজায়, সে কি আইনের দোষ?

 ভারতীর মুখ দেখিয়া মনে হইল না সে কিছুমাত্র লজ্জা পাইল। বলিল, লোকে মিথ্যে বলবে না, মিধ্যে মামলা সাজাবে না, তবেই আইন নির্দ্দোষ হয়ে উঠবে, এই আপনার মত না কি? এ হলে ত ভালই হয়, কিন্তু সংসারে তা হয় না এবং হবার বোধ করি বিস্তর বিলম্ব আছে। এই বলিয়া সে একটু হাসিল, কিন্তু অপূর্ব্ব চুপ করিয়া রহিল, তর্কে যোগ দিল না। সেই প্রথম দিনে এই মেয়েটির কণ্ঠস্বরে,

৪১