পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এক মা-ঠাকুরাণী ছাড়া তাহার শুচিতায় কেহ প্রশ্ন করিতেও পারে ইহাতে সে মনে মনে আহত হইয়াছিল, কিন্তু আচার-বিচার লইয়া এই ম্লেচ্ছ মেয়েটার কাছেই সে সতর্ক না হইয়াও পারে নাই। তখন এ-সকল তাহার ভাল লাগে নাই, যাহা ভালো লাগিয়াছে তাহারও তেমন করিয়া মর্য্যাদা উপলব্ধি করে নাই, অথচ, এই সব চিন্তাই যেন এখন তাহাকে বিভোর করিয়া দিত। বর্ম্মায় সে আর ফিরিবে না। যাইবার পূর্ব্বে দেখা হইবার আর আশা নাই, দেখা করিবার হেতু নাই, যত কিছু সে জানে বলিবার লোক নাই— দিনের পর দিন একই পথের প্রান্তে নিষ্ফল দৃষ্টি পাতিয়া একাকী চুপ করিয়া বসিয়া তাহার বুকের মধ্যেটা যেন আঁচড়াইতে থাকিত।

 সেধিন আফিস হইতে ফিরিয়া অপূর্ব্ব হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, ভারতীর বাসাটা ঠিক কোন্ জায়গায় রে তেওয়ারী?

 তেওয়ারী সংশয়তিক্তকণ্ঠে জবাব দিল, আমি কি গিয়ে দেখে এসেচি নাকি?

 যাবার সময় তোকে বলেনি?

 আমাকে বলতে যাবে কিসের জন্যে।

 অপূর্ব্ব কহিল, আমাকে বলেছিল বটে, কিন্তু জায়গাটা ঠিক মনে নেই। কাল একবার খুঁজে দেখতে হবে।

 তেওয়ারীর মনটা দুলিতে লাগিল, হয়ত কি আবার একটা ফ্যাসাদ জুটিয়াছে,—কিন্তু এ সাহস তাহার হইল না যে কারণ জিজ্ঞাসা করে। অপূর্ব্ব নিজেই বলিল। কহিল, সে চুরির জিনিসগুলো এখন পুলিশের লোকে দিতে চায়, কিন্তু ভারতীর একটা সই চাই।

 তেওয়ারী আর একদিকে চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল, অপূর্ব্ব বলিতে লাগিল, সেদিন একথাই ত জানাতে এসে তোর অবস্থা দেখে আর ফিরতে পারলেন না। তিনি না দেখলে ত তুই কবে মরে ভূত হয়ে যেতিস্ তেওয়ারী, আমার সঙ্গে পর্য্যন্ত দেখা হ’ত না!

 তেওয়ারী হাঁ-না কিছুই কহিল না, শেষ কথাটা শুনিবার জন্য নিঃশব্দে কাঠের মত বসিয়া রহিল। অপূর্ব্ব বলিল, এসে দেখি অন্ধকার ঘরে তুই আর তিনি। দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই, কি যে ঘটবে তার ঠিক নেই, কোথায় খাওয়া, কোথায় শোওয়া, দুদিন আগে নিজের বাপ-মা মরে গেছে,—কিন্তু কি শক্ত মেয়েমানুষ তেওয়ারী, কিছুতে অক্ষেপ নেই!

 তেওয়ারী আর থাকিতে না পারিয়া বলিল, কবে গেলেন তিনি?

 অপূর্ব্ব কহিল, আমার আসার পরদিনই। ভোর না হতেই ‘চললুম’ বলে যেন একেবারে উবে গেলেন।

৮২