পাতা:পদাবলী-মাধুর্য্য.djvu/২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
২২
পদাবলী-মাধুর্য্য

চৈতন্যদেব গয়া হইতে ভাগবত পাদ-পদ্ম দর্শন করিয়া নদীয়ায় ফিরিয়া আসিয়া প্রিয় গদাধরের কাঁধে হেলাইয়া কি দেখিয়াছেন, বলিতে পারেন নাই, বলিতে যাইয়া মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িয়াছেন। রাধা এখানে যাহা বলিতেছেন, তাহা নিবিড় ও অস্পষ্ট,—

“সখীর সহিতে জলেরে যাইতে সে কথা কহিবার নয়।
যমুনার জল করে ঝল্‌মল তাহে কি পরাণ রয়।” (চ)

 এইখানেই শেষ, যমুনার জল ঝল্‌মল্‌ করে, তাহাতে প্রাণে এত ব্যথা কেন? এ ব্যথা, আনন্দের ব্যথা—আনন্দের আতিশয্যে বাক্‌রোধ যমুনার জলে সূর্য্যাস্তের রক্তিম আভা পড়িয়া ঝল্‌মল্‌ করিয়া উঠে, রাধা কি তাহাই বলিতেছেন? সন্ধ্যানিলে স্বর্ণচূড় যমুনাতরঙ্গ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে, রাধিকা কি সেই কথা বলিতেছেন? যমুনার জলে সখীদের নীল শাড়ীর আভা মিশিয়া যে ঔজ্জ্বল্য খেলিতে থাকে, রাধা কি সেই কথা বলিতেছেন? রাধা তো কিছু খুলিয়া বলেন নাই; তবে কি সে ভাব, যাহাতে তাঁর প্রাণ এমন আকুল হয়?

 তরুশাখে স্থিত ময়ুরপুচ্ছালঙ্কৃত কৃষ্ণের প্রতিবিম্ব পড়াতে যমুনার জল ঝল্‌মল্‌ করিয়া উঠে, তাহাই তিনি দেখিতে যাইতেছেন; যমুনার পথে সেই কথা মনে হওয়াতে রাধার আনন্দে বাক্‌রোধ হইতেছে। সেই অবর্ণনীয় সুখের কথা—যমুনার নীল জলে প্রতিবিম্বিত কৃষ্ণরূপের কথা—বলিতে যাইয়া ভাবের উদ্বেলের আতিশয্যে তিনি আর কিছু বলিতে পারেন নাই, শুধু বলিতেছেন,

“যমুনার জল, করে ঝল্‌মল্‌, তাহে কি পরাণ রয়?”

এইভাবে অর্দ্ধ-প্রকাশ—অর্দ্ধ-অপ্রকাশ কণ্ঠের ভাষায় চণ্ডীদাস তাঁহার রাধাকে চিত্রিত করিয়াছেন, এই স্তব্ধ চিত্র দেখিলে মনে হয় যেন কুবের তাঁহার ভাণ্ডার আগলাইয়া দাঁড়াইয়াছেন—তাহার বাহ্য প্রকাশ নাই।