পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০
পদ্মানদীর মাঝি

 কুবের লক্ষ করিয়া আশ্চর্য হইল, এই আমিনুদ্দি, আজ একটি বিশিষ্ট ব্যক্তি হইয়া উঠিয়াছে। হােসেন মিয়ার দিকে সে চাহিয়া নাই, সে চাহিয়া দেখিতেছে আমিনুদ্দিকে। আমিনুদ্দির অস্বস্তিও অত্যন্ত সুস্পষ্ট। জহরের মধ্যস্থতায় অনেকবার বিবাদ মিটিলেও মনে মনে আমিনুদ্দির উপর কুবেরের রাগ ছিল। চোখে চোখে মিলিতে সে চোখ ফিরাইয়া লইল।

 কেহ কথা কহে না। কী ভাবিয়া হােসেন মিয়া হঠাৎ কুবেরকেই বিলম্বিত সম্ভাষণ জানাইয়া বসিল।

 পিছে বইলা ক্যান কুবের বাই? আগাইয়া বও। খানাপিনা হয় নাই?

 কুবের হঠাৎ বড়াে উল্লাস বােধ করিল। আগাইয়া সকলের সামনে গিয়া বসিয়া বলিল, খাইছি মিয়া বাই।

 বাঁ হাতে নিজের লালচে দাড়ি মুঠা করিয়া ধরিয়া হােসেন মিয়া বলিল, গণেশরে দেহি না? গেছে কই?

 কে জানে? ফিরতি বেলায় মেলার মদ্যি মাইজা কর্তা ডাইকা কয়, গাঁয়ে ফেরস নাকি গণেশ?—মাছগুলা বাড়ি দিয়া আসিস, লইয়া যা। কইয়া একডালা ইছামাছ দিলেন। মাছ দিবার লাইগা গণশা কর্তাগাে বাড়ি গেছে সন্দ করি।

 মেজোকর্তার নাম অনন্ত তালুকদার। কেতুপুর গ্রামখানি তাহারই। জেলেপাড়ার যাহারা দু-একবিঘা জমি রাখে, মেজোকর্তাকেই তাহারা খাজনা দিয়া থাকে। মেজোকর্তার নামােল্লেখে সকলে মন দিয়া কুবেরের কথা শুনিল। হােসেন মিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কর্তা আলেন কবে?

 আলেন আর বিষ্যুদবারে।

 হীরু মাঝি চোখ মিটমিট করিতে করিতে বলিল, মাইজা কর্তার সগল সংবাদ দেহি রাখস কুবের, ভুবন সা-র লগে মামলার কী হইল ক দেহি?

 কুবের বলিল, কর্তা হাঁসচরের দখল পাইছেন। ভুবন সা-র নায়েব নাকি কয়েদ হইছে খবর শুনি জ্যাঠা। সাঁইথির কুঞ্জ গোঁসাই সাক্ষী দিছে, স্যায় নাকি নিজের চোখে নায়েবরে কর্তাগাে কাছারি ঘরে আগুন দিতি দেখিলাে।

 পীতম বলিল, হ? তুই জানলি কিবা?

 কুবের সগর্বে বলিল, ইডা কী জিগাও মামা? আমার জাননের বাকি কী?

 শেতলবাবুর ঠাঁই জানলাম।

 শীতলের নামােল্লেখে পীতম মাঝি নিঝুম হইয়া গেল। নকুল শয়তানি করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, শেতলবাবু? তেনারে পালি কই কুবের?

 কুবের হাসিয়া বলিল, নকুলদা য্যান পােলাপান, জান না কিছু। শীতলবাবুর ঠাঁই পয়সা পামু, কাল রাইতে আমাগাের যুগীর বাড়িতে তাগিদ দিবার গেছিলাম। পয়সা দিবার মতলব ডাকাইতটার নাই, খাতির কইরা কইল, বয় রে কুবের, তামুক খা। তামুক টানি রাইজ্যের গল্প কইরা আইলাম। কইলি না পিত্যয় যাবা নকুলদা, শেতলবাবু কয় মাইজাবাবু দেনায় ডুবছে।