পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫২
পদ্মানদীর মাঝি

গ্রাম হইতে আরও পনেরাে টাকা উঠিল। তার মধ্যে সাত টাকা দেওয়া হইল কেতুপুরের নন্দ ভট্টাচার্যকে; আহা, ব্রাহ্মণের দুখানা ঘর পড়িয়া গিয়াছে। জেলেপাড়ার জন্য দেওয়া হইল দশ টাকা, দু টাকা করিয়া পাঁচজনকে। বাকি টাকাটা বােধ হয় ফাণ্ডে জমা রহিল।

 সুখের বিষয় দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর এইসময় হােসেন মিয়া গ্রামে ফিরিয়া আসিল। ঘুরিয়া ঘুরিয়া সে চারিদিকের অবস্থা দেখিয়া বেড়াইল, তারপর দাড়ি নাড়িয়া বলিল, না, টাকা কর্জ দিমু না, ছন দিমু, বাঁশ দিমু, নিজে খাড়াইয়া তােমাগাে ঘর তুইল্যা দিমু—শ্যাষে নিকাশ নিয়া খত লিখুম, একটা কইরা টিপ দিবা।

 তাই সই।

 পুরাতন জীর্ণ ঘরের বদলে যদি নূতন ঘর ওঠে, খত লিখিয়া দিতে আর আপত্তি কী? ঘর যাহাদের পড়িয়া গিয়াছিল সকলে তাহারা খুশি হইয়া উঠিল। যাহাদের ঘর পড়ে নাই তাহারা দুঃখিত হইয়া ভাবিল, ঘরদুয়ার তাহাদেরও পড়িয়া গেলে মন্দ হইত না!

 সকলেই সাগ্রহে হােসেন মিয়ার সাহায্য গ্রহণ করিল, করিল না শুধু আমিনুদ্দি। সে মাথা নাড়িয়া বলিল, না মিয়া, ঘর দিয়া আমার কাম নাই।

 আমগাছের তলে তাহার ঘরখানা যেমন নিষ্পেষিত হইয়া পড়িয়াছিল তেমনিভাবে পড়িরা রহিল। সত্যিই তাে, ঘর দিয়া আমিনুদ্দি কী করিবে? কে আছে আমিনুদ্দির? কার জন্য আবার সে দুঃখের, দারিদ্র‍্যের নীড় বাঁধিবে? জেলেপাড়ার সকলেই আবার পদ্মার বুকে নৌকা ভাসাইয়াছে, আমিনুদ্দি কোথাও যায় না, কার জন্য পদ্মার অতল জলে সে জীবিকার সন্ধান করিবে? শুধু মেয়েটা আছে—মমীন। কেন আছে কে জানে! সারাদিন মমীন মৃদুস্বরে কাদে, আমিনুদ্দি চাহিয়াও দেখে না, না ডাকে কাছে, না বলে মেয়ের সঙ্গে কথা।

 ক্রমে ক্রমে সকলের নূতন খুঁটি নূতন বেড়া ও নূতন চালার ঘরগুলি সমাপ্ত হইল। হােসেন মিয়া মজুরদের কী ইঙ্গিত দিয়াছিল সে-ই জানে, কুবেরের ঘরটা উঠিল সকলের আগে। ঘর দেখিতে আসিয়া হােসেন মিয়া গােপির জন্য বড়াে দরদ দেখাইল। বলিল, হাসপাতালে নিয়া যাও কুবের বাই, জবর চোট পাইছে মালুম হয়।

 তারপর একখানা খত বাহির করিয়া বলিল, টিপ সই দেও কুবের—একুশ টাহা দশ আনার খত লিখিছি—বাদ দিছি দুই টাহা। টিপ সই দিয়া রাখ, যখন পারবা দিবা—না দিলি মামলা করুম না বাই!—হােসেন মিয়া মৃদু মৃদু হাসিল, জান দিয়া তােমাগাে দরদ করি, খত কিসির? লিখা থুইলাম, হিসাব থাকব—না-ত কিসির কাম খত দিয়া?

 কুবের বলিল, পুরান বাঁশ, পুরান বেড়া দিলি খরচা কম হইত মিয়া বাই।

 ক্যান? পুরান বাঁশ দিবা ক্যান? খরচার লাইগা ভাইবো না, খরচা তাে দিছি আমি! না, দিই নাই?

 হ, মিয়া বাই দিছেন, আপনেই দিছেন।

 টিপসই দিয়া কুবের হােসেনের মুখের দিকে চাহিল। বড়াে ভয় করে কুবের হােসেন মিয়াকে, বড়াে টান তাহার হােসেন মিয়ার দিকে। কী জাদুমন্ত্রে তাহাকে বশ করিয়াছে লােকটা?

 গােপির পায়ের ব্যথাও কমে না, ফোলাও কমে না। মেয়েটাকে নিয়া মহা মুশকিলে