পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৬৩

কেন যেন ফিরিতে ইচ্ছা হইতেছিল না, অনেক রাত্রি অবধি নদীতীরে বসিয়া থাকিয়া সে হােটেলে ভাত খাইতে গেল। খাইতে খাইতে সে শুনিতে পাইল বাজারে আজ ভাসান-যাত্রা হইতেছে। আজ কুবের কাছে না থাকিলে কেহ ভয় পাইবে না, খাইয়া উঠিয়া সে বাজারের দিকে পা বাড়াইল।

 বাজারে টিনের চালার নীচে যেখানে তরিতরকারির দোকান বসে সেইখানে যাত্রার আসর বসিয়াছে, লােক জমিয়াছে ঢের। কুবের একপাশে বসিয়া পড়িল। পানবিড়ির দোকান ছাড়া এত রাত্রে পসরা সাজাইয়া কেহ নাই, রূপ-কন্যারাও যাত্রা শুনিতে আসিয়াছে। পেশাদার দল নয়, আলু-বেচা তেল-বেচা মানুষের শখের দল, অনেকে হয়তাে পড়িতেও জানে না, একে ওকে দিয়া পড়াইয়া শুনিয়া শুনিয়া পার্ট মুখস্থ করিয়াছে, শক্ত শক্ত অনেক শব্দই উচ্চারণ হয় না, তাই হাস্যকর রকমে ভাঙিয়া জিহ্বার উপযােগী করিয়া নিয়াছে—বক্তৃতাগুলি কথ্য ও শুদ্ধ ভাষার এক অপরূপ খিচুড়ি। পােশাক পরিচ্ছদের যেমন অভাব, অভিনেতা নির্বাচনে কাণ্ডজ্ঞানেরও তেমনই অভাব। বালক লখিন্দরের পাশে তার চেয়ে একহাত বেশি লম্বা বেহুলা নির্বিকারচিত্তে পার্ট বলে—গলাটি মিহি বলিয়া আর চমৎকার মেয়েলি ঢঙে অভিনয় করিতে পারে বলিয়া ওকে বেহুলা করা হইয়াছে, আর কিছু দেখিবার প্রয়ােজন হয় নাই।

 তবু রাত জাগিয়া ভিড় করিয়া সকলে ভাসান-যাত্রা শোনে, একবার নয় বহুবার। ভাঙা হারমােনিয়াম আর ঢ্যাপসা তবলার সঙ্গত, মশালের লাল আলাে, আলু-বেচা তেল-বেচা অভিনেতা—তবু কী মােহ এ যাত্রার! কুবের ঠায় বসিয়া থাকে। ঢিমাইয়া ঢিমাইয়া অভিনয় চলে, মা মনসা একটা গান করেন, চাঁদ সদাগর দুটো কথা বলে, মৃত লখিন্দর উঠিয়া একটা গান করিয়া আবার মরিয়া যায়। কোথায় কখন কোন দৃশ্যের শুরু, সর্পদষ্ট লখিন্দরের জন্য বেহুলার বহুল বিলাপের পর মা মনসা আবার কেন গান গাহিয়া গাহিয়া চাঁদ সদাগরকে ভয় দেখাইয়া যান যে তাকে পূজা না করিলে লখিন্দরকে সাপে কাটিবে, এসব বুঝিবার দরকার হয় না। কুবের মন দিয়া যাত্রা শােনে। রাত্রি শেষ করিয়া যাত্রা শেষ হইলে পেঁয়াজের যে খালি বস্তাটার উপর সে এতক্ষণ বসিয়া ছিল তার উপরেই কাত হইয়া ঘুমাইয়া পড়ে। কিন্তু বেশিক্ষণ ঘুমানাের সুযােগ সে পায় না। সকাল হইতে না হইতে তাহাকে ঠেলিয়া তুলিয়া দেওয়া হয়। সেখানে এবার দোকান বসিবে।

 অনেক বেলায় সে গ্রামে ফেরে। দেখিতে পায় বাড়িতে অতিথি আসিয়াছে। কপিলার স্বামী শ্যামাদাস!

 লম্বা চওড়া প্রকাণ্ড জোয়ান মানুষ, ঘাড়-ছোঁয়া বাবরি চুল মাথায়, বোঁচা নাকটার নীচে একজোড়া উদ্ধত গোঁফ—খুঁটিতে ঠেস দিয়া বসিবার ভঙ্গি দেখিলে মনে হয় বিশ্বজগতে কারাে সে তােয়াক্কা রাখে না। কুবেরের মুখখানা ম্লান হইয়া যায়। কে জানে কেন আসিয়াছে শ্যামাদাস!

 শ্যামাদাসের আসিবার উদ্দেশ্য জানিতে বেশি দেরি হইল না। এপক্ষের বউটা তাহার মরিয়া গিয়াছে। কপিলাকে সে নিয়া যাইবে। কখন যাইবে? বেলা পড়িয়া আসিলে একসময়