পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৮
পদ্মানদীর মাঝি

গণেশও হােসেন মিয়ার খপ্পরে আসিয়া পড়িবে এটা কুবেরের ভালাে লাগিতেছিল না।

 তবু, গণেশেরও একটা উপায় হওয়া চাই।

 ঢোঁক গিলিয়া কুবের জিজ্ঞাসা করিল, গণেশকে নিতে পারে না হােসেন মিয়া? গণেশ বলবান, পাকা মাঝি গণেশ—বুদ্ধিটা একটু ভোঁতা বটে কিন্তু জেলেপাড়ায় ওর মতাে লগি ঠেলিতে, দাঁড় টানিতে আর কেহ পারে না।

 হােসেন বলিল, ডাইকা আনবা গণেশরে?

 অখন?

 হ, যাও বাতচিত কইরা যাই।

 কুবের অনিচ্ছার সঙ্গে উঠিয়া গেল। হােসেন মিয়াকে একা বাড়িতে রাখিয়া যাইতে তার ভরসা হয় না। গণেশকে নিয়া ফিরিয়া আসিয়া সে দেখিল, ইতিমধ্যে সংবাদ পাইয়া আমিনুদ্দি আসিয়া হােসেন মিয়ার কাছে বসিয়াছে। আমিনুদ্দিকে দেখিলে চিনিতে পারা যায় না। কয়েকদিন আগে জহরের ছেলের সঙ্গে মেয়েটার সে বিবাহ দিয়াছে, স্ত্রীপুত্রের অপমৃত্যুর পর এত তাড়াতাড়ি মেয়ের বিবাহ দিতে সকলে তাহাকে বারণ করিয়াছিল, কারাে কথা সে শােনে নাই। যেটুকু বন্ধন ছিল তাও সে অধীর হইয়া চুকাইয়া ফেলিয়াছে। এবার সে কী করিবে সেই জানে!

 কুবেরকে দেখিয়া আমিনুদ্দি বলিল, ময়নাদ্বীপি যামু গিয়া কুবির, কাইজা মনে থুইও না, কসুর মাপ কইরাে বাই।

 ময়নাদ্বীপি যাবা? ক্যান?

 কই যামু, না তাে?

 কুবের ও গণেশ অভিভূত হইয়া আমিনুদ্দির দিকে চাহিয়া রইল। সকলকে হারাইয়া রাসু একদিন ময়নাদ্বীপ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছিল, এখানে সকলকে হারাইয়া আমিনুদ্দি আজ ময়নাদ্বীপে যাইতেছে। আমিনুদ্দিকে ওখানে নেওয়ার জন্য হােসেন অনেকদিন হইতে চেষ্টা করিতেছিল, এতদিনে তাহার মনস্কামনা পূর্ণ হইল—হােসেনের কোনাে ইচ্ছা কি অপূর্ণ থাকিবার নয়? ভয়ে তাহারা হােসেন মিয়ার দিকে তাকাইতে পারে না। মনে হয় আশ্বিনের ঝড় নয়, হােসেন মিয়াই আম গাছ ফেলিয়া আমিনুদ্দির কুটিরখানি চূর্ণ করিয়া দিয়াছিল। লােকে যে বলে কোনাে কোনাে মানুষের ভূত-প্রেতের ওপর কর্তৃত্ব থাকে, হােসেনেরও তাই আছে কিনা কে জানে! একদিন রাত্রে সে যে হােসেন মিয়ার পকেট হইতে পয়সা চুরি করিয়াছিল সেকথা মনে করিয়া কুবেরের বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করিতে থাকে। এমন অলৌকিক শক্তি যার, সে কি টের পায় নাই চুরির কথা? ঘরের চালা হয়তাে নয়, হয়তাে হােসেনের পােষ-মানা অন্ধকারের অশরীরী শক্তি সেদিন গােপির হাঁটু ভাঙিয়া দিয়াছিল, বাড়ি ছিল না বলিয়াই কুবের সেদিন বাঁচিয়া গিয়াছিল নিজে? মেঘলা অমাবস্যার অন্ধকারের মতাে অতল কুসংস্কার নাড়া খাইয়া কিছুক্ষণের জন্য কুবেরের মনকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে।