পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৮১

সঙ্গে অবিরত সংগ্রাম চলিয়াছে, অনেক খাদ্য এখানে উৎপন্ন করা যায় না, জীবনের অনেক প্রয়ােজন মিটাইতে সমুদ্রপথে পাড়ি দিতে হয় সভ্য জগতের দিকে। অবিশ্রাম খাটুনি এখানে, অসংখ্য অসুবিধা এখানে, জীবন এখানে নির্মম ও নীরব। রাসুর মতাে অনেকে তাই পালাইয়া গিয়াছে। হােসেনের পাঁচ বছরের চেষ্টায় দ্বীপে তাই ত্রিশটির বেশি পরিবার নীড় বাঁধে নাই। আমিনুদ্দি ও রসুলকে ধরিলে দ্বীপের গৃহস্থ পরিবারের সংখ্যা এবার বত্রিশ হইল মাত্র।

 কী কঠিন কাজে হােসেন মিয়া যে আত্মনিয়ােগ করিয়াছে, কী সীমাহীন যে তাহার ধৈর্য ও অধ্যবসায়, এবার কুবের তাহা ভালাে করিয়া বুঝিতে পারে। এই নিচু, জলা ও জঙ্গলপূর্ণ মনুষ্যবাসের অযােগ্য দ্বীপ, ধান ছাড়া আর কোনাে ফসল যে দ্বীপের লােনা মাটিতে জন্মে না, লাউ কুমড়াগুলি ফলে কুঁকড়ানাে শশার মতাে ছােটো ছােটো—এখানে এই মুষ্টিমেয় নরনারীর বসতি স্থাপন করাও হােসেন মিয়া ছাড়া আর কারও দ্বারা সম্ভব হইত না। সন্দ্বীপ, হাতিয়া, ধনমানিক, বাবনাবাদ এইসব জনপূর্ণ দ্বীপের কথা কুবের শুনিয়াছে, ময়নাদ্বীপ যদি মানুষের বাসের যােগ্য হইত ওইসব দ্বীপের মতাে কবে এখানে গড়িয়া উঠিত গ্রাম। এ কী কদর্য একটা দ্বীপ হােসেন বাছিয়া লইয়াছে?

 হয়তাে সস্তায় পাইয়াছিল বলিয়া। স্বাস্থ্যকর, উর্বর দ্বীপ কিনিয়া জমিদারি পত্তনের টাকা হােসেন কোথায় পাইত, ওরকম জনহীন দ্বীপই বা কোথায়।

 দ্বীপ দেখিয়া আমিনুদ্দি ও রসুল বড়াে দমিয়া গিয়াছে। ফিরিয়া যাওয়ার কথাটাও তাদের মুখে শােনা গিয়াছে দু-একবার। তবে হােসেনের সামনে তারা কিছু বলে নাই। বলা যায় না। কত উপকার যে হােসেন তাদের করিয়াছে তার হিসাব হয় না। আমিনুদ্দি অপরিশােধ্য আর্থিক ঋণেই শুধু আবদ্ধ নয়, হােসেন না দিলে এ জীবনে স্ত্রী কি আর তাহার জুটিত—নছিবনের মতাে স্ত্রী? রসুলকে জেলের দুয়ার হইতে ছিনাইয়া নিয়া আসিয়াছে হােসেন, দেশে ফিরিলে জেলেই হয়তাে তাহাকে ঢুকিতে হইবে। প্রতিদানে হােসেন আর কিছুই তাদের কাছে চায় না, তারা শুধু এখানে বাস করুক, স্বপ্ন সফল হােক হােসেনের। ইতিমধ্যে তাদের জন্য ঘর উঠিতে আরম্ভ হইয়াছে, দয়া করিয়া ওই ঘরে তারা নীড় বাঁধিলে কৃতার্থ হইয়া যাইবে হােসেন। জঙ্গল কাটিয়া যত জমি তারা চাষের উপযােগী করিতে পারিবে, সব তাদের সম্পত্তি। খাজনা বা চাষের ফসল কিছুই হােসেন দাবি করিবে না। নিজেদের জীবিকা তাহারা যতদিন নিজেরাই অর্জন করিতে পারিবে না, জীবিকা পর্যন্ত যােগাইবে হােসেন। গৃহ ও নারী, অন্ন ও বস্ত্র, ভূমি ও স্বত্ব সবই তাে পাইলে তুমি, এবার শুধু খাটিবে ও জন্ম দিবে সন্তানের, এটুকু পারিবে না?

 হােসেনের কাছে ফিরিয়া যাওয়ার কথা তাই কেহ মুখে আনিতে পারে না। ফিরিয়া যে যায়, সে যায় পালাইয়া, চুপিচুপি, চোরের মতাে।

 হােসেন তাদের ক্ষমা করে। দেখা হইলে রাসুর মতাে হােসেন তাদের জঙ্গল সাফ করার মজুরি দেয়। জোর-জবরদস্তি হােসেনের নাই, অন্যায় সে কারও প্রতি করে না।