পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৫০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫০০
পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা

 ইহার অর্থ, ভদ্র লোকেরা জলদস্যু হার্ম্মাদগণের ভয়ে বাড়ীর আশে পাশে গোলাম, ধোপা, এবং নাপিত (নাই) দের বসাইয়া ছিলেন। শেষোক্ত বলশালী লোকেরা পল্লীর রক্ষক স্বরূপ উপনিবিষ্ট হইয়া ছিল।

 সুজাবিলাপ পালাতেও আমরা এই হার্ম্মাদদের উল্লেখ পাইয়াছি। কিন্তু বোধ হয় এই পালাগানটিতেই হার্ম্মাদদের সম্বন্ধে কিছু বেশী বৃত্তান্ত পাওয়া যাইতেছে। হার্ম্মাদদের ভয় এত বেশী হইয়াছিল যে বাণিজ্যনৌকাগুলি অনেক সময়ে সমুদ্রপথে এক যাইতে সাহসী হইত না। বহু ডিঙ্গা একত্র হইয়া সমুদ্রে রওনা হইত। এই ডিঙ্গাগুলির মিছিল ‘বহর’ নামে পরিচিত। ডিঙ্গাস্বামীদের সর্ব্বাপেক্ষা সাহসী ও কর্ম্মঠ ব্যক্তির উপাধি ছিল ‘বহরদার’। তাহারই নির্দেশমতে সকলে পরিচালিত হইত।

 এই নূরন্নেহা এবং কবরের কথা পল্লীসাহিত্যের একটি উজ্জ্বল রত্ন। ইহাতে একনিষ্ঠ প্রেমের যে নিদর্শন আছে তাহার তুলনা নাই। নূরন্নেহাকে আমরা মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ নায়িকাদের সঙ্গে এক পঙ্‌ক্তিতে স্থান নাও দিতে পারি। যেহেতু সেই সকল চরিত্রে প্রেমের সঙ্গে উদ্ভাবনীশক্তি এবং নানা বুদ্ধির চাতুর্য্যের মিশ্রণ আছে। উক্ত চরিত্রগুলি কতকটা জটিল এবং খরপ্রতিভাশালী। কিন্তু নূরন্নেহা স্বভাবের শিশু। প্রেমই তাহার জীবন এবং তাহার বঁচিবার উপাদান ও অবলম্বন। শেষকালে কবর হইতে যখন অশরীরী দেহে সে জানাইল যে প্রকৃত প্রেমের ধ্বংস নাই, বিদেহ হইলেও প্রেম যায় না, তখন সেই সুরের অপার্থিব রেশ আমাদের কানে চিরদিনের জন্য লাগিয়া রহিল। শেষ অধ্যায়ে যেন স্বর্গের সঙ্গে পৃথিবীর মিলন হইল। একদিকে আজীবন নিষ্ঠার জীবন্ত মূর্ত্তি নূরুন্নেহা, আর এক দিকে শোকোন্মত্ত মালেক। ইহাকে দেখি, কি উহাকে দেখি তাহা ঠিক করা যায় না, উভয়েই এরূপ অতুল সুন্দর। এই পালাগানটিতে নানা প্রকার অমার্জ্জিত প্রাকৃত কথার বাহুল্য থাকা সত্ত্বেও আমরা বঙ্গদেশের যে পল্লীচিত্রটি পাইতেছি তাহা বাঙ্গলা মাটির খাটি জিনিষ। এখন আমাদের সাহিত্যে যে কৃত্রিমতা আসিয়া ঢুকিয়ছে, তাহার পার্শ্বে এই অকৃত্রিম চিত্রগুলি রাখিলে