পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৫০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫০৪
পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা

দ্বীপে দর্শন করিয়া যেরূপ বিস্মিত হইয়াছিলাম, এই কুমারীর সন্দর্শনেও আমাদের তদ্রূপই বিস্ময় হইয়াছিল। নির্জ্জনে ঋষির আশ্রমে শকুন্তলা, সমুদ্রের উপকূলে কপালকুণ্ডলা এবং এই গভীর অরণ্যে পার্ব্বত্য কুমারী যেন এক হাতের আঁকা ছবি। কুমারী বিন্দুমাত্র পারিবারিক জীবনে অভ্যস্ত ছিল না। বন্য হরিণীর ন্যায় সে অরণ্যে ছুটিয়া বেড়াইত, ধনুর্ব্বাণহস্তে সে পুরুষবেশে শিকার করিত এবং তাহার স্বভাবজাত সৌন্দর্য্য আরণ্য সরলতার সহিত মিশ্রিত হইয়া তাহাকে এক বনদেবতার মত সুন্দরী করিয়া তুলিয়াছিল। ইহা একটি রাজকুমারের সঙ্গে রাজকুমারীর পরিণয়ের কাহিনী নয়। এখানে রাজকুমারী সম্পূর্ণ অসংস্কৃত, সামাজিকতার অতীত এক অপূর্ব্ব ললনা। কানন-কুসুমকে রাজকুমার রাজবাটীকার উদ্যানে লইয়া আনিয়াছিলেন। সে বেশভূষা জানিত না, কাহাকে কি বলিয়া সম্বোধন করিতে হয় তাহা জানিত না। অতি তেজস্বিনী হইয়াও সে একটি ননীর পুতুলের ন্যায় কোমলপ্রাণ। যেমনি তাহার অবয়বে তেমনি তাহার কথাবার্ত্তায় নিত্যনিত্য রাজকুমার নব সৌন্দর্য্য এবং অপূর্ব্বত্ব আবিষ্কার করিতেন। এ যেন পৃথিবী এবং স্বর্গের মিলন। কিন্তু এই পর্ব্বতীয়―নিতান্ত বন্য রমণীর হৃদয়ে যে প্রেম ছিল, তাহা অতীব একনিষ্ঠ; তাহাতে পাতিব্রত্যের ও শাস্ত্রীয় সংস্কারের কোন চিহ্ন নাই; কিন্তু তথাপি তাহা এত ঐকান্তিক ও একনিষ্ঠ, যে সেই প্রেম সর্ব্বশাস্ত্রকে অতিক্রম করিয়া উঠিয়াছে। গীতিকথাটি সমাপ্ত করিয়া আমাদের মনে সেই নিষ্কলঙ্ক অপাপবিদ্ধ ও সরল ধনুর্দ্ধারিণীর চিত্রটি মনে থাকিবে। সে রাজকুমারকে পাইয়া যেরূপ আনন্দিত হইয়াছিল এবং সেই আনন্দের কথা যেরূপ আবেগে প্রকাশ করিয়াছিল বোধহয় পৃথিবীর কোন নায়িকা তাহা করে নাই। অসভ্য দুর্বৃত্তদিগের হাত হইতে কুমারকে সে কিভাবে রক্ষা করিবে এই ছিল তাহার প্রধান ভাবনা। একদিন গাছের উপর পত্রান্তরালে, অন্যদিন বৃক্ষের কোটরে, অন্যদিন তাহার কুটিরের পার্শ্বে সে কুমারকে লুকাইয়া রাখিল―যেন সে হারানো মাণিক―কত দুর্লভ ধন। গীতিরচয়িতা বলিতেছেন সে ত শাস্ত্রও পড়ে নাই, সামাজিকতাও জানিত না, কেহ গল্প করিয়াও তাঁহাকে প্রেমের কাহিনী শোনায় নাই। তবে সে