পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
১৫

 কুমারের মন যখন কুঞ্জলতা হইতে আস্তে আস্তে ফিরিয়া শৈশবের আশ্রয়, সেবিকাবেশিনী কাঞ্চনের প্রতি আকৃষ্ট হইতে লাগিল, তখন দুই রমণী যে পরস্পরকে লুকাইয়া কুমারের প্রতি অনুরাগের পাল্লা দিতেছিলেন, সে দৃশ্যে কবি মনস্তত্ত্বের একটা দিক‌্ প্রকাশ করিয়াছেন। কুমার লুকাইয়া নিদ্রিতা কাঞ্চনমালাকে কপাটের আড়াল হইতে চোরের মত সন্তর্পণে দেখিতেছেন। কুঞ্জলতাকে গোপন করিয়া কাঞ্চনের সঙ্গে চুপে চুপে কথা কহিতেছেন। অথচ কুঞ্জের কুমারগত প্রাণের নীবর ব্যাকুলতা ও সতর্ক চক্ষু তাঁহার সমস্ত ফন্দী আবিষ্কার করিয়া ফেলিতেছে। তিনি সহিতে পারিতেছেন না, এবং কহিতে পারিতেছেন না; ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করিতেছেন। অবশেষে কুমার একটা ভুল করিয়া বসিলেন, যাহা কুঞ্জের অসহ্য হইয়া উঠিল। তিনি শিকারে যাত্রা কালে সাশ্রনেত্রে কাঞ্চনের নিকট বিদায় লইলেন,―অথচ কাঞ্চনমালা যাঁহার ক্রীতদাসী, যিনি রাজকুমারী ও তাঁহার বিবাহিতা স্ত্রী―তাঁহার কাছে বিদায় লইতে ভুলিয়া গেলেন। এদিকে কাঞ্চন ও একটা ভুল করিয়া ফেলিল। একদিন বর্ষায় যখন সারারাত্র ধরিয়া বৃষ্টি পড়িতেছিল, যখন প্রকোষ্ঠ একান্ত নির্জন ও মন গত ব্যথায় ভরপুর, সেই পরিপূর্ণ হৃদয়াবেগের অসতর্ক মুহুর্ত্তে সে রাজকুমারীর কথায় ভুলিয়া তাঁহার জীবনের সমস্ত রহস্য অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠে বলিয়া ফেলিল; সে রাত্রির দৃশ্যটিও ভুলিবার নহে। কাঞ্চনের উক্তি মর্ম্মস্পর্শী; তাহার করুণা পাষাণকেও দ্রব করিতে পারে, কিন্তু পারিল না কেবল রাজকুমারীর মর্ম্মস্পর্শ করিতে। তিনি বুঝিলেন, এই পরিচারিক তাঁহারই মত বড় ঘরের মেয়ে এবং সে তাঁহার স্বামীর পুর্ব্বপরিণীতা স্ত্রী। কুমারের উপর তাঁহারও যে দাবী, কাঞ্চনের তদপেক্ষা বরং বেশী দাবী। এইবার স্ত্রীচরিত্রের কোমলতা চলিয়া গেল। স্ত্রীলোক ভাগের প্রেম করিতে চায়না, এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের ন্যায়-অন্যায় বিচার থাকে না। অতি ক্রুর কৌশল অবলম্বন করিয়া তাঁহার মাতা ও তিনি কাঞ্চনকে নির্ববাসিতা করিয়া দিলেন। সর্ব্বশেষ অঙ্কটি হিমাদ্রির গৌরীশৃঙ্গের মত মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। কুঞ্জ যে পরীক্ষা দিয়াছেন, তাহা অগ্নি পরীক্ষারও উপরে। কৃষক কবি যে এতবড় আদর্শ কোথায় পাইলেন, তাহা জানিনা। স্বামী অন্ধ