পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৫৩

যে লিখিয়াছেন, অমরমাণিক্য ‘মচলন্দানি’ উপাধি ইশাখাঁকে প্রদান করিয়াছিলেন, ইহা সম্ভবতঃ ত্রিপুরারাজের মনোরঞ্জনের জন্য। কিন্তু এ সম্বন্ধে আমরা বেশী কিছু বলিতে চাই না; আমাদের বক্তব্য সংক্ষেপে পাদটীকায় লিখিত হইল।[১]

 রাজমালার বিবরণে পাওয়া যাইতেছে যে, ইশাখাঁ এখন বায়ান্ন হাজার সৈন্যের অধিকারী হইলেন।’ সম্ভবতঃ এই সময় হইতেই তিনি স্বাধীনতালাভের চেষ্টা করিতে থাকিবেন। সারাইল পরগণায় থাকিয়া তাঁহার এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের কোনই সম্ভাবনা ছিলনা। কারণ সেখানে তিনি ত্রিপুরা রাজের করদ বা সামন্ত রাজা বলিয়াই পরিগণিত হইতেন। ইহা ছাড়া আরও কতকগুলি কারণের জন্য ইশাখাঁর পক্ষে সারাইল পরগণায় অবস্থিতি বিশেষ বাঞ্ছনীয় ছিল না। যুবরাজ রাজধর একবার শিকারে বহির্গত হইয়া দেখিলেন যে সারাইল পরগণার জঙ্গলাকীর্ণ স্থান সমূহ বহুবিধ বন্যমহিষ, ব্যাঘ্র ভল্লুক এবং মৃগ প্রভৃতির আবাসস্থল। শিকারের লোভে আকৃষ্ট হইয়া যুবরাজ তিতাশ নদী পার হইয়া এই পরগণার অন্তঃপাতী বনমধ্যস্থ ৪২টি গ্রামের মধ্যে বিচরণ করিতে করিতে সারালাইল পরগণায় একটি বিশ্রামাবাস নির্ম্মাণের কল্পনা করিতে

  1. ইশাখাঁর কামানের উপর যে উপাধি লিখিত হইয়াছে, তাহা মসনদালি নহে। প্রথম অক্ষরটি স্পষ্ট নহে (ইহা দাগমাত্র হইতে পারে)। ষ্টেপলটন সাহেব ও একটি জিজ্ঞাসার চিহ্ন (?) সংযোগ করিয়া এটিকে “ব” পড়িয়াছেন। যাহা হউক, এটিকে বাদ দিয়া পরিলে শব্দটি “মসনন্দাল্বি” হয়। ষ্টেপলটন-ধৃত “ব-মস-দীফি” পাঠ কোনমতেই স্বীকার করা যাইতে পারে না। “মচলন্দালি” পদটি কামানে উৎকীর্ণ “মসনন্দাল্বি” পদের অনেকটা অনুরূপ।  ইহাই কি ‘মসনদালি’ শব্দের বাঙ্গালা ভাষায় লিখিত রূপান্তর। আমি যতদূর জানি দেওয়ান পরিবারের কাগজ পত্র ছাড়া অন্য কোথাও এই উপাধি দিল্লীশ্বরের প্রদত্ত, একথার প্রমাণ পাওয়া যায় না। দিল্লীর সম্রাট্‌ দিগের সহিত জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ান পরিবারের সম্বন্ধ স্থাপনের চেষ্টা আমরা পূর্ব্বাপর দেখিয়া আসিতেছি বলিয়া তাঁহাদের মত গ্রহণ করিতে আমাদের একটু সন্দেহ হয়। দেওয়ানদিগের প্রেরণায় লিখিত বিবরণগুলিতে ত্রিপুরারাজ অমর মাণিক্যের সহিত ইশাখাঁর সমস্ত সংস্রব লোপ করিবার চেষ্টার কারণ কি? আকবর সাহ কর্ত্তৃক এই খিলাত প্রদত্ত হইলেও দেওয়ান পরিবারে বংশপরম্পরায় তাহ রক্ষিত হয় নাই, ইহাও লক্ষ্য করিবার বিষয়। ত্রিপুরার সংস্রব স্বীকার করিলে ইশাখাঁ কতকটা হীন হইয়া পড়েন এবং তাঁহার সহিত দিল্লীশ্বর ও গৌড়েশ্বরদের ধারাবাহিক আত্মীয়তাস্থাপনের চেষ্টার কতকটা বিঘ্ন হয় বলিয়াই কি তাঁহারা ঈশাখাঁর জীবনের এই গৌরব হীন প্রথম অধ্যায় লুপ্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন? অথচ রাজমালার প্রমাণ ছাড়াও সারাইল পরগণার বহুবিধ প্রমাণ আছে, যাহাতে ইশাখাঁ এক সময়ে সে সেই অঞ্চলে যুদ্ধবিগ্রহ করিয়াছিলেন, একথা স্পষ্টই প্রতিপন্ন হয়।