পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৮৫

করিতে হইবে। চণ্ডীদাসের ভাষায় জলের মধ্যে আশীর্ষ ডুবিয়া স্নান করিতে হইবে, অথচ গাত্র ভিজিবে না। এই অসম্ভব ব্রত যিনি পালন করিতে পারিবেন, তিনি আসুন, অপরে নহে। অপরে চেষ্টা করিলে সে চেষ্টা “শিবনৃত্যের” অনুকরণে “ভূতের নাচের” মত হাস্যাস্পদ হইবে। অথচ তিনি বলিতেছেন, তাঁহার সময়ে না জানিয়া না শুনিয়া, “সহজ সহজ সবাই কহয়”—শত শত তরুণ-তরুণী এই পথের পথিক হইতে প্রয়াস পাইতেছিলেন। সেই সময়ে একদিকে সহজ-সাধন, অপর দিকে প্রাক্ বৌদ্ধযুগের নিবৃত্তিধর্ম্মের প্রতিক্রিয়ার ফলে নরনারীর অবাধ মিলন—বঙ্গ সমাজে এই দুইটি স্রোত বহিতেছিল। এই পল্লীগানগুলিতে দৃষ্ট হয়, বাঙ্গালীর রমণীরা প্রেমকে একটা খেলার বস্তু বলিয়া গ্রহণ করেন নাই। সহজিয়াদের মত তাঁহারা ইহাকে ধর্ম্ম বলিয়া গ্রহণ না করিলেও এই বিষয়ে যে তাঁহাদের যথেষ্ট সাধনা ছিল, তাহা গীতিকার পাঠকমাত্রেই বুঝিতে পারিবেন। এই প্রেম দুর্ব্বল-হৃদয়ে নারী প্রমত্ত কুঞ্জরের বল দিয়াছে। ইহা “একটুকু হাসি,” “একটুকু স্পর্শ,” এবং “একটুকু চুম্বন” নহে। ইহার প্রতি অধ্যায়ে সুকঠিন তপস্থ্যা। পল্লী গীতিকার এই খণ্ডে “মহিষাল বন্ধু,” “ধোপার পাঠ” ও “কাঞ্চনমালা” পাঠ করুন; প্রথম খণ্ডে “কাজলরেখা,” “মহুয়া,” “চন্দ্রাবতী,” “মদিনা” প্রভৃতি অনেক নারীচরিত্র সম্বন্ধই পাঠক অবহিত আছেন। এই রমণীদের প্রেমে স্বর্গ ও মর্ত্ত্যের মিলন সূচিত হইয়াছে; ইহারা প্রেমের জগতে সাধনার পথ ধরিয়া চলিয়াছেন। যে সাধনা ঋষি মুনিরা করিয়া থাকেন, পঞ্চাগ্নির মধ্যে বসিয়া সূর্য্যের প্রতি বদ্ধলক্ষ্য পঞ্চতপাঃ যে সাধনা করিয়া থাকেন, বাহিরের আড়ম্বর না থাকিলেও এই প্রেম তেমনই একটা নীরব সাধনা। এই প্রেম আত্মসুখাভিলাষী নহে, ইহা আত্মবলিদানেই সার্থক। যত তান্ত্রিক, যত যোগী, এদেশে যে সাধনা করিয়াছেন—শবের উপর বসিয়া কিংবা ছিন্নমস্তার ন্যায় নিজের অঙ্গ বলি দিয়া যে তপস্যায় সিদ্ধিলাভ হইয়াছে, সে সমস্ত সাধনাকে— বজ্রাসন, পদ্মাসন, শবাসন প্রভৃতি সমস্ত আসনকে—হার মানাইয়াছে, এই কন্দর্পের কোমল আসন। ইহার বাহিরে পুষ্পরেণু ও নবনীতের কোমলতা, কিন্তু ইহা বজ্রগর্ভ। বাঙ্গালী জাতি, বিশেষ বাঙ্গালী নারী যে অপূর্ব্ব প্রেমসাধনা করিয়াছেন,—কোমলতার ভিতর দিয়া যে সুকঠিন অদর্শ লাভ করিয়াছেন,