পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সাধারণ মন্তব্য

 এই পল্লীগীতিকাগুলির ঐতিহাসিক ও কবিত্বমূলক যথেষ্ট মূল্য আছে। কিন্তু তাহা ছাড়া আর একটা দিক্ দিয়া ইহারা বঙ্গ সাহিত্যের একটা যুগনির্দ্দেশ করিতেছে। আমি তৎসম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলিব।

 হরিদ্বারে যাইয়া যেরূপ গোমুখীর শত শত ধারা কিরূপে বিশালতোয়া গঙ্গায় পরিণত হইয়াছে, দেখিতে পাওয়া যায়, এই গীতিগুলিতেও সেইরূপ নানা বেগশীল স্বচ্ছধারা প্রবাহিত হইয়াছে, উত্তর কালে সেই ধারাগুলি বঙ্গসাহিত্যকে বিশেষ পুষ্টি ও বিশালতা দান করিয়াছে।

 বিশেষ করিয়া আমরা এখানে এই গীতিগুলির সহিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম্ম ও বৈষ্ণব গীতি-সাহিত্যের সম্বন্ধের কথা বলিব।

 খ্রীঃ পূঃ তৃতীয় শতাব্দীতে বৌদ্ধদিগের “একাভিপ্পায়”-সম্প্রদায়ের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। ইহাতে যৌনসম্বন্ধ ধর্ম্মের ভিত্তিতে পরিণত করিবার প্রচেষ্টা হইয়াছিল। বৃহদারণ্যক উপনিষৎ হইতে আরম্ভ করিয়া নানাবিধ পুরাণেও যৌন-সম্পর্কের আনন্দের সঙ্গে বারংবার ব্রহ্মানন্দ উপমিত হইয়াছে। এই সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইঙ্গিত দ্বারা আমরা বঙ্গের ‘সহজিয়া ধর্ম্মে’র মূল কোথায়, তাহার আভাস পাই।

 চণ্ডীদাসের কবিতাপাঠে জানা যায়, তাঁহার সময়ে সহজ সাধনা তরুণতরুণীদের একটা বিশেষ আচরিত পন্থায় পরিণত হইয়াছিল। চণ্ডীদাস এই তরুণসাধকদিগকে ভয় দেখাইয়া নিরস্ত করিয়াছিলেন। এই পথে সিদ্ধিলাভের সম্ভাবনা প্রায় আকাশকুসুমবৎ—‘কোটিকে গোটিক হয়,” এই আশঙ্কার কথা বলিয়া তিনি নবীন যাত্রীদিগকে এই পথ হইতে ফিরিয়া যাইতে উপদেশ দিয়াছেন। এ পথে কাহারা যাইবেন? এই প্রশ্ন করিয়া চণ্ডীদাস উত্তরে বলিয়াছেন, যে ব্যক্তি সুমেরু-শৃঙ্গকে মাকড়সার জাল দিয়া বাঁধিতে পারিবেন, যিনি সাপের মুখে ভেককে নাচাইয়া অক্ষত দেহে তাহাকে ফিরাইয়া আনিতে পারিবেন, তিনি এই পথে যাউন, অপরে নহে। এ বড় দুর্গম পন্থা, দেহকে সম্পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয়প্রভাব বিরহিত “শুষ্ক কাষ্ঠের” মত