পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৮৭

সঙ্গে এদেশের বিরহ-মথিত যে করুণ স্মৃতি জড়িত, তাহা শুধু প্রতিশব্দ দিয়া বুঝান যায় না।

 খাটি বাঙ্গালায় “যমকের” যে বহর আছে, পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় তাহার তুলনা আছে কিনা জানি না। কত শব্দ ও শব্দাংশের দ্বারা যে খাটি বাঙ্গালার অভিধান পুষ্ট হইয়াছে, তাহা এখন পর্য্যন্ত বঙ্গের অভিধানকারদিগের নজরেই পড়ে নাই। বলা বাহুল্য যে সুকোমল ভাবব্যঞ্জনাতেই এই সকল শব্দের সূক্ষ্ম ও বিচিত্র অর্থ বঙ্গের ঘরে ঘরে পুষ্ট হইয়াছে। এক “ভাল” শব্দটির কত অর্থ হইতে পারে, তাহা এই ছত্রটিকে দেখুন:—“ভাল ভাল বঁধু ভাল ত আছিলে। ভাল সময় এসে ভালই দেখা দিলে।” প্রথম “ভাল ভাল” দুইটি শব্দের অর্থ—বেশ্ বেশ্, তৃতীয় “ভাল”টি স্বাস্থ্যজ্ঞাপক, চতুর্থ “ভাল”টির অর্থ “ঠিক” এবং পঞ্চম “ভাল”র অর্থ “উচিত কাজ”। সামান্য বানানের তফাৎ কিন্তু উচ্চারণ এক রকম, অথচ অর্থ সম্পূর্ণরূপে পৃথক, এরূপ শত শত শব্দ বাঙ্গালার ঘাটে পথে পাওয়া যায়:—যথা “শয়ন করিয়া সে কুসুম শেজে, হৃদয়ের মাঝে রাখি মোরে সে যে”। প্রথম “শেজ” অর্থ শয্যা; দ্বিতীয় “সে” আর “যে” দুইটি পৃথক শব্দ হইলেও উচ্চারণের সাদৃশ্যের দরুণ একই শব্দের মত মনে হয়। এরূপ আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে, “শোন গো নীরবে, বাঁশী বাজে ঐ কি রবে, বলদেখি ও রবে, কে ঘরে রবে।” প্রথম “রব” অর্থ “শব্দ”; শেষের “রবে”, “রহিবে”র রূপান্তর।” “চল্ গো যে যাবে, শশি-মুখে বাঁশী কতই বাজাবে”। “বাজাবে”র ‘জাবে’ ও “যাবে” দুইটি ভিন্ন শব্দ, কিন্তু উচ্চারণ একরূপ। “কানু কহে রাই, কহিতে ডরাই, ধবলী চরাই বনে”—এই ছত্রটিতে “রাই” শব্দ কত বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হইয়াছে। “যদি না পাই কিশোরীরে, কাজ কি শরীরে।” এখানে “কিশোরীরে” ও “কি শরীরে” কেমন মিলিয়া গিয়াছে; অথচ দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক শব্দ। “আমি যে রাধার লাগি হ’লাম বনবাসী, ধরাচূড়া বাঁশী কতই ভাল বাসি”— এখানে “বনবাসী”র “বাসী”, “বাঁশী” এবং “ভালবাসি”র “বাসি” ধ্বনিতে প্রায় একরূপ হইয়াও ভিন্ন ভিন্ন অর্থ সূচক। “হেথা থাক্‌তে বদি মনে না থাকে, তবে যেও সেথাকে” এবং “যথা যে না থাকে, তারে আর