পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৮
পূর্ব্ব‌বঙ্গ গীতিকা

কোথা কে, ধ’রে বেঁধে কেবা রেখে থাকে” এখানে প্রথম ও দ্বিতীয় পদের দুইটি “থাকে” পদের প্রতি লক্ষ্য করুন। এক শব্দ বাঙ্গালায় কতই না খুটি নাটি ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইতেছে। “নেত্র পলকে যে নিন্দে বিধাতাকে, এত ব্যাজে দেখা সাধে কি গো তাকে” এবং “যেন সুধাকরে সুধা বরিষন করে”—এই দুটি ছত্রের মধ্যে ও “তাকে” এবং “করে” শব্দ দুইটির প্রতি লক্ষ্য করুন। “যতই কাঁদে বাছা বলি সর সর, আমি অভাগিনী বলি সর্ সর্, বল্‌লাম নাহি অবসর, কেবা দিবে সর” পদে প্রথম “সর” অর্থ নবনীত, দ্বিতীয় “সর্” অর্থ “দূর হ’” তৃতীয় “সর” “অবসরে”র। “শুন হে কেশব বল্‌বে লোকে সব”—এখানে “কেশব” ও লোকেসবে’র “কেসব”দুইটি শব্দের ধ্বনি-সাম্য লক্ষ্যণীয় “আমার মরণ সময়ে কি কাজ ভূষণে, এভূষণ নাহি যাবে কভু সনে” এখানে “ভূষণ” ও কভু সনের“ভুসন” দ্রষ্টব্য।

 আমি একটা খাতায় এরূপ শত শত শব্দ টুকিয়া রাখিয়াছিলাম। এই শব্দ কলায় যে সূক্ষ্ম‌ বাক্‌শিল্প প্রদর্শিত হইয়াছে, তাহার বিন্যাস ঢাকার মস্‌লিন্ কিংবা তারের কাজের বুনুনীর মত। এই যে শত শত শব্দের অতি নিপুণ কারুকার্য্যে আমাদের ভাষা অলঙ্কৃত হইয়াছে, তাহা কাহারও নজরে পড়ে নাই। প্রাজ্ঞমানী সমালোচক গোবিন্দ অধিকারী ও কৃষ্ণকমলের পদে এই যমকালঙ্কারের বাহুল্য দেখিয়া নাসাকুঞ্চন করিয়াছেন। হয়ত, কতকটা বাড়াবাড়ি তাঁহাদের ছিল। কিন্তু জাতীয় ভাষার মহৈশ্বর্য্যের সন্ধান যাঁহারা পাইয়াছিলেন, তাঁহারা যদি পরম গর্ব্বের সহিত একটু বেশী দ্রুত ছুটিয়া চলিয়া থাকেন, তজ্জন্য তাঁহারা নিন্দনীয় নহেন—তাঁহাদের কাছে, যাঁহারা বাঙ্গালাভাষার এই মহা-শক্তির সন্ধানটা একেবারেই রাখেন না। বাঙ্গালা ভাষারূপ পদ্মের এই শত সুকোমল পাপড়ী বাঙ্গালীর প্রেমসরোবরে জন্মিয়াছিল। বাঙ্গলা ভাষায় এই অসামান্য সম্পদ দাশরথী যতট। আবিষ্কার করিয়াছেন—অপর কেহ বোধ হয়, ততদূর পারেন নাই। পূর্ব্বে যে সকল শব্দের উল্লেখ করিয়াছি তাহা খাঁটি বাঙ্গালা শব্দ। কিন্তু সংস্কৃত শব্দের যোগে বাঙ্গালা ভাষায় যেরূপ সুমধুর যমকের সৃষ্টি হইতে পারে, জয়দেবের সংস্কৃতেও তেমন যমকের মাধুর্য্য কদাচিৎ দৃষ্ট হয়। দুই একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। “সখী ধর আভরণে দিও রাই চরণে, যেন মরণে কিশোরী কৃপা করে মোরে”