পাতা:প্রকৃতি বনাম মানুষঃ একটি পরিকল্পিত সংঘাত - মাধব গাডগিল.pdf/১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তার সাহস বাড়ায়। সেজন্যই শিকার মানুষের কাছে একটা বিনোদনমূলক অভিজ্ঞতা হিসেবেই বিবর্তিত হয়েছে। ভারতবর্ষে শিকারের খুবই রেওয়াজ ছিল ১৯৫০-এর দশকেও, তখন আমি স্কুলছাত্র। এমন অনেককেই চিনতাম যারা তাদের মৃগয়া নিয়ে আনন্দ আর অহঙ্কার প্রদর্শন করতেন। নিজেদের দক্ষ ও সাহসী শিকারি হওয়ার দাবির সমর্থনে তাঁরা তাদের পশু-স্মারক দেখাতেন, ছবি দেখাতেন। সাধারণত, ছবিগুলোয় শিকার করা প্রাণীর শরীরের উপর একটা পা রেখে দাঁড়ানো। আমার একজন কাকা ছিলেন, যিনি ইণ্ডিয়ন সিভিল সার্ভিস-এ যুক্ত ছিলেন। তাঁর বিলাসবহুল বাংলোর সমস্ত ঘরেই ইতিউতি ছড়ানো থাকত বাঘের চামড়া। বেশ আপ্লুত স্বরেই তিনি আমায় সেইসব শিকারের গল্প করেছেন সমগ্র জীবনকালে, বিশেষ করে চিতা এবং অন্যান্য বাঘের। সেলিম আলীর মুম্বাই-এর পালি হিল-এর বাংলোতেও একটা চিতাবাঘের চামড়া আছে। সেলিম আলীর বহু মহারাজা বন্ধুরই ব্যক্তিগত সংরক্ষিত ক্রীড়াঙ্গন ছিল যেখানে শুধুমাত্র তাদের এবং তাদের অতিথিদের জন্য শিকার সংরক্ষিত ছিল। ১৯৭২ পর্যন্ত বহু মহারাজাই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রোজগার করেছেন তাদের সংরক্ষিত ক্রীড়াঙ্গনে অতিথি হিসেবে ইউরোপিয় পর্যটকদের শিকার করতে দিয়ে।

 জীবন-জীবিকা ধ্বংস

 ব্রিটেনে যেমন সামন্ত প্রভুরা সারা দেশের সমস্ত জমিই দখল করে রেখেছিল, ভারতের ক্ষেত্রে অবস্থা তেমন ছিল না। দেশীয় রাজ্যগুলোর সংরক্ষিত জল এবং জমি ভারতের মোট ভূখণ্ডের সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র। পর্যাপ্ত জায়গা উন্মুক্তই থাকত, এমনকি মানুষের বসতির কাছাকাছিও অসংখ্য বন্যপ্রাণী ঘুরে বেড়াত এবং অভিজাত এবং সাধারণ উভয় ধরণের মানুষই তাদের শিকার করতেন। বন্যজন্তুদের প্রাচুর্য অব্যাহত ছিল রাজাদের সংরক্ষিত ক্রীড়াঙ্গনে এবং তার বাইরেও। এর একটা কারণ বন্দুকের অপ্রতুলতা হলেও, তাদের বিচক্ষণতার ঐতিহ্যও একটা অন্যতম কারণ। সমকালীন বাস্তুতান্ত্রিক তত্ত্ব দেখিয়েছে যে একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে একটি প্রজাতির সংখ্যার “প্রজননশীল মূল্য” বেশি থাকে। ঐ পর্যায়টিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেবার কারণেই প্রজাতিটি বিপুল সংখ্যায় টিকে থাকতে পেরেছে। গর্ভবতী ও বাসা-বানানো পাখিরা এই পর্যায়টির উদাহরণ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—Phasepardhis নামক যাযাবর শিকারি জনজাতিরা (মূলত মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশবাসী) তাদের ফাঁদে পড়া কোনো গর্ভবতী হরিণকেই রেহাই দিত না। অথচ ভারতের বিভিন্ন অংশেই পরম্পরাগতভাবেই সারস জাতীয় পাখিদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নিরাপত্তা দেওয়া হত প্রজনন ঋতুতে। এইরকম অনেক পেশাদার শিকারিসংগ্রাহক সম্প্রদায়, কৃষকদের সঙ্গে একধরণের বোঝাপড়া রেখে চলত। তারা চাষিদের ফসল ধ্বংসকারী পোকা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করত। উত্তর ভারতের বহেলিয়া এরকম এক জনজাতি। ১৮৫৭ সালে সাতনায়, পিন্দ্রা গ্রামে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহেলিয়াদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। ১৮৫৭-র পর ব্রিটিশরা এই ধরণের সম্প্রদায়ের ওপর প্রতিশোধ নেবে ব’লে মনস্থির করে। সেই অনুযায়ী ১৮৭১ থেকে নানারকম ফৌজদারি আইন চালু হল ক্রিমিনাল ট্রাইব্স অ্যাক্টের আধারে। এই আইনগুলোর ন্যায্যতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ব্রিটিশ আধিকারিক জে এফ স্টিফেন বলেন, “পেশাদার অপরাধীদের সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, আমরা মনে করছি যে জনজাতির পূর্বপুরুষেরা অপরাধী ছিল স্মরণাতীতকাল থেকে। তারা তাদের জাতকে ব্যবহার করত অপরাধ করার জন্য। সেই জাতিগুলোর উত্তরপুরুষেরাও একইভাবে আইনের চোখে অপরাধী হবে, যতদিন না সম্পূর্ণ জাতিটা নির্মূল হয়ে যাচ্ছে।”১১ ১৯৩৬ সালে জওহরলাল

14