পাতা:প্রকৃতি বনাম মানুষঃ একটি পরিকল্পিত সংঘাত - মাধব গাডগিল.pdf/১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নেহেরু এই আইনটার নিন্দা করে বলেছিলেন, “এই আইনে যে দানবীয় বিধান রয়েছে তা মানুষের নাগরিক স্বাধিকারকেই নাকচ করে। কোনো জনজাতিকে এভাবে অপরাধী বলা যায় না। কোনো সভ্য নীতির সঙ্গে এই বক্তব্য আদৌ সাযুজ্যপূর্ণ নয়।” ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময়ে, কোনো সম্প্রদায়ের কোনো একজন সদস্যকেও নির্ধারিত এলাকার বাইরে দেখা গেলেই তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের সম্মুখীন হতে হতো। এভাবেই ১২৭টি সম্প্রদায়ের ১.৩ কোটি মানুষ খানাতল্লাশির আওতাভুক্ত ও গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৯ সালের আগষ্ট মাসে এই আইন বাতিল করা হয়। আগেকার ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’ বিনথিভুক্ত হয়েছিল ১৯৫২ সালে। তবে, তাদেরকে অধীনস্ত রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েই সরকার নিয়ে এলেন Habitual Offenders Act 1952। যার অর্থ স্বভাবসিদ্ধ অপরাধী আইন, ১৯৫২। এখন ভারতবর্ষে ৩১৩-টা যাযাবর জনজাতি রয়েছে যাদের বেশিরভাগকেই অপরাধী জনজাতি হবার তকমা উত্তারাধিকার সূত্রে আজো তাড়া করে চলেছে। তার সঙ্গে চলেছে নিরন্তর বিচ্ছিন্নতা আর পুলিশ, গণমাধ্যম, বনদপ্তর এবং শহুরে সংরক্ষণবাদীদের দেওয়া অদ্ভুত অপরাধী দুর্নাম। মাদারিদের মতো একটা বিনোদিনী সম্প্রদায় বাঁদরদের নিজেদের বেশ আয়ত্তে রেখেছিল এবং তাদের কাণ্ডকারখানা ছোট বয়সে আমার ও আমার বন্ধুদের বেশ আনন্দ দিত। WLPA-এর মধ্যে দিয়ে, কলমের একটা আঁচড়ে, নিতান্ত বোকার মতোই এইরকম অজস্র মানুষের জীবিকা শুধু কেড়েই নেওয়া হল না, সন্তোষজনক এবং বিকল্প জীবিকার কথা ভাবাও হলনা। এই পদক্ষেপ হল আসলে ইচ্ছাকৃতভাবে এই মানুষদের ধীরে ধীরে দারিদ্রের দিকে ঠেলে দেওয়া। এর তুলনা করা চলে একমাত্র সেইসব ব্রিটিশ প্ল্যাণ্টারদের সঙ্গে যারা ১৮৬০-এ স্থানান্তরী কৃষি নিষিদ্ধ করতে চাপ দিয়েছিল প্রায় ক্রীতদাসত্বের শর্তে তাদের বাগানে মজুরদের প্রয়োজন মেটাবার জন্য।

 অধীনতা

 এটা কোনো সমাপতন নয় যে WLPA-তৈরি হবার সঙ্গে সঙ্গেই, এমনি এমনিই সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার মূল্যে হওয়া ধ্বংসাত্মক উন্নয়নের বিরুদ্ধে গ্রামে গঞ্জে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ প্রতিরোধ ঘনীভূত হতে শুরু করেছিল, যার জলজ্যান্ত প্রমাণ চিপকো আন্দোলন। এই আইনটা বনদপ্তরের ক্ষমতা অসম্ভব বাড়িয়ে তুলেছিল। আইনটার আগে, বনদপ্তরের চৌহদ্দি সীমিত ছিল শুধুমাত্র সেইটুকু জমিতেই যেটুকু ‘জঙ্গলের জমি’ হিসেবে স্বীকৃত, নথিভুক্ত ছিল; তাও ভারতের মোট ভূখণ্ডের প্রায় ২৩%। WLPA সেটাকে সারা ভারতে প্রসারিত করেছে। যেহেতু বহু সহস্রাব্দ ধ’রেই ভারতের একটা বড় অংশের গ্রামবাসিরা এবং বনবাসিরা প্রোটিনের প্রয়োজনে এবং ফসলের নিরাপত্তার জন্য পশুশিকার করত, WLPA এদেরকে অপরাধী প্রতিপন্ন করতে ক্রিমিনাল ট্রাইব আইনকেও ছাপিয়ে গেছে। ভারতের আইনটা বিশেষ; অন্যান্য দেশের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনগুলো তাদের জাতীয় উদ্যান, সংরক্ষিত অরণ্য ব্যবস্থাপনা বা অন্য সবকিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকে, দেশের বাকি অঞ্চল এসব আইনের চৌহদ্দির বাইরেই থাকে। অন্যান্য বহু পার্থক্য সত্ত্বেও এমনটাই ঘটে কেনিয়া বা আমেরিকায়। কেনিয়ার মানুষ ব্যাপকভাবেই তথাকথিত ‘বুশমিট’ খায় এবং তাই নিয়ে তাদের আইন খুব একটা নাক গলায় না। আমেরিকার মানুষ সংরক্ষিত এলাকার বাইরে একটা ‘মৃগয়া অনুমতি’র বিনিময়ে শিকার করতে পারতেন।

 চিপকোর আন্দোলনকারীরা প্রাথমিকভাবে গাছ কাটা আটকাতে সফল হয়েছিলেন গাড়োয়াল অঞ্চলে। গোপেশ্বরের দাশোলি গ্রাম স্বরাজ্য মণ্ডল, যারা এই প্রতিবাদে বেশ ভালোরকম জুড়ে ছিলেন, পরবর্তীতে তাঁরা গঠনগত কার্যক্রম হিসেবে একটি ধারাবাহিক প্রকৃতি-উন্নয়ন ক্যাম্প

15