পাতা:প্রকৃতি বনাম মানুষঃ একটি পরিকল্পিত সংঘাত - মাধব গাডগিল.pdf/২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বাসস্থানের পরিসর (৪) তার ট্যাক্সোনমিক বা বিন্যাসবিধিগত অবস্থানের অনন্যতা এবং (৫) সংকটের মাত্রা-র ওপর। এই কাঠামোয় সব দিক থেকেই ঘড়িয়াল, হাতি বা বাঘ উভয়ের চেয়েই অনেক বেশি মূল্যবান বলে প্রমাণিত হয়েছে। (১) ঘড়িয়ালকে দেখা যায় মিষ্টি জলে এবং তা বাঘ বা হাতির মতো জঙ্গলের অধিবাসীদের চেয়ে অনেক বেশি বিপন্ন। (২) ঘড়িয়াল গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্রের মতো মাত্র কয়েকটি নদী উপত্যকাতেই সীমাবদ্ধ। অথচ বাঘ, হাতি প্রভৃতি প্রাণী অনেক বড় এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে। বেশ কিছু দেশেও দেখা যায়। (৩) ঘড়িয়ালের পছন্দের আবাসস্থল বেশ সংকীর্ণ; আর বাঘ বিপুল জঙ্গলাকীর্ণ যে কোনো জায়গায় থাকতে পারে। হাতি আবার যেমন নানা বৈচিত্র্যময় জঙ্গলে থাকতে পারে বা ঝোপঝাড়ে থাকতে পারে, তেমনই আবার চাষজমিতেও হানা দেয়। (৪) বাঘ বা হাতির তুলনায় ঘড়িয়ালের প্রজাতিসংখ্যা (taxa) অনেক কম। (৫) ঘড়িয়ালের সংখ্যা ১৯৪৬-এ ১০,০০০ থেকে ২০০৬-এ ২৫০-এর থেকেও কমে গেছে, যেখানে বাঘ এবং হাতির সংখ্যা যথেষ্ট বেশি এবং ক্রমবর্ধমান। তবুও আমরা এই দুই প্রজাতিকে নিয়ে আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে থাকি।

জীববৈচিত্র্যের সঙ্কট

ঘড়িয়ালের সংখ্যা হ্রাস চিহ্নিত করে ড্যাম, ব্যারেজ, সেচ খাল, কৃত্রিম বাঁধ, পলি প’ড়ে নদীর গতিপথ বদলে যাওয়া, বালি খাদান, সীসা আর ক্যাডমিয়ামের মতো ধাতুর জন্য বেশি মাত্রায় ঘ’টে চলা দুষণের জন্য নদীতীরবর্তী আবাসস্থলের ক্ষয় হয়ে চলেছে। সত্যিই বায়ু, জল, মাটির দূষণ এবং আবাসস্থলের পরিবর্তন আজকের ভারতবর্ষে জীববৈচিত্র্যের ওপর সবচেয়ে শক্তিশালী ভীতিরূপ। এই আসন্ন সঙ্কট WLPA-তে নিষিদ্ধ হওয়া প্রজাতি শিকারের চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর। দূষণ এবং আবাসস্থল ধ্বংস করাকে রীতিমতো উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে যার জন্য দেশের প্রকৃতি পরিবেশ গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দুঃখের বিষয় হল আমাদের দেশের পল্যুশন কণ্ট্রোল বোর্ডগুলো বহির্সজ্জায় মনোনিবেশ করে আছে এবং সৎভাবে কোনো রেকর্ড রাখছে না। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে EIA (Environment Impact Assessment) ২০২০-র বিজ্ঞপ্তিতে। ঘোষণায় ভয়ঙ্কর দূষণকারী, এমনকি লাল সতর্কতাযুক্ত শিল্পকেও কৌশলগতভাবে জরুরী বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং গণবিবেচনা বা গণশুনানির থেকে তাদের এভাবে আড়াল করা হয়েছে।

সারা দেশে প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক আবাসস্থল নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েই চলেছে। জঙ্গল এলাকায় চাষবাসের প্রসারের ফলে আবাসস্থলের পরিবর্তন এর মধ্যে অত্যন্ত তুচ্ছ একটি ঘটনা। তার চেয়ে অনেক বেশি ক’রে দায়ী হল ধনীদের জন্য বিশাল বিশাল অট্টালিকা, রাজসড়ক এবং রেললাইনের নির্মাণ, বন্দর এবং বিমানবন্দর। এই নির্মাণকাজে সাহায্য করতে পাথরখাদান, বালিখাদান, চুনাপাথরের খাদান, কয়লা খনি হচ্ছে ও অন্যান্য খনিজ উত্তোলন চলছে। মহারাষ্ট্রের সমৃদ্ধি হাইওয়ে সারা রাজ্য জুড়েই তার বিস্তৃতি কায়েম করেছে। পথে কোনো টিলা থাকলেও তাকে আদৌ তোয়াক্কা করে না সে। সোজা সেসব ভেদ ক’রে জঙ্গল তথা বন্যপ্রাণীদের আবাসভূমি ধ্বংস ক’রে এগিয়ে যায়। যেসব ঝর্ণা আশপাশের গ্রামের চাষের প্রাণ, সেগুলোকেও ধ্বংস করে। বসতহীন বন্যপ্রাণীরা গ্রামে গ্রামে হানা দেয়। হায়নারা গৃহপালিত পশুদের আক্রমণ করছে এবং চিতাবাঘেরা মানুষদের গুরুতরভাবে জখম করছে।

21