পাতা:প্রকৃতি বনাম মানুষঃ একটি পরিকল্পিত সংঘাত - মাধব গাডগিল.pdf/২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

প্রাণীদের অন্তর্নিহিত প্রবণতাই হল সংখ্যা বৃদ্ধি। চার্লস ডারউইন একটি অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত দিয়েছিলেন। উনি বলেছিলেন যে এমনকি হাতির মতো ধীরে শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করা প্রাণী সংখ্যায় বেড়েই চলবে যদি না এই বিষয়গুলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এভাবে ৭৫০ বছরে এই হাতিগুলো একটার ওপর আরেকটা চেপে এমন স্তুপাকৃতি ধারণ করবে যে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের প্রায় এক ষষ্ঠাংশ দূরত্ব অতিক্রান্ত হয়ে যাবে।১৬ অবশ্যই বন বাস্তুতন্ত্রের ভেতর যে কাল্পনিক ভারসাম্য রয়েছে, তা বড় বড় বন্য প্রজাতিগুলির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তেমন ভূমিকা পালন করে না, বরং জঙ্গলের বাইরে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি থাকে। শিকারকে অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক বিষয় হিসেবে বুঝতে হবে এবং সর্বত্রই মানুষ ছিল সবচেয়ে বড় শিকারি সমস্ত প্রজাতির ক্ষেত্রেই, ভারতীয় উপমহাদেশে যেমন হাতি। যেমন আগেই বলেছি, হাতিরা মানুষের চেয়ে অনেকটা পরেই ভারতীয় উপমহাদেশে বসত করতে শুরু করেছে এবং তারা দৃশ্যমান হবার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষেরা তাদের শিকার করতে শুরু করে। নর্মদা নদীর উপত্যকায় ভীমবেটকার ১০,০০০ বছরের পুরনো গুহাচিত্রে এই শিকার চিত্রায়িত আছে। ২০০০ বছর আগে রোম্যাণ্টিক কবিতার একটি সংকলন লেখা হয়েছিল গথসপতাসাটি নামের একটি অঞ্চলে, যেখানে বর্ণনা করা আছে কীভাবে একজন যুবক কনে পাবার আশা করবে এবং একটা হাতি শিকার করে তার পৌরুষ প্রমাণ করবে। কেরালার মুন্নারের ঝা ঁচকচকে টি এস্টেট মালিকদের টেবিলের পায়াগুলি তৈরি হতো শিকার করা হাতির পায়ের নীচের অংশ দিয়ে। এই শিকার হঠাৎ একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল WLPA-র জন্য, দস্যু বীরাপ্পনের মতো জাজ্বল্যমান ব্যতিক্রমকে বন্দি হতে হল এবং ফলশ্রুতিতে সমস্ত প্রজাতির বন্যপ্রাণীরাই বড় মাত্রায় উধাও হতে লাগলো।

আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বদল এসেছে। Optimal foraging theory নামে বাস্তুশাস্ত্রবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা আছে যা প্রাণীদের খাদ্য সংগ্রহ সম্পর্কিত বিষয়টিগুলিকে গুরুত্ব দেয়। প্রাণীরা এমন খাদ্যগ্রহণ করতে চায়, যেখানে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পুষ্টিকর খাবার পাবার জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে কম সময়ে ও সবচেয়ে কম সম্ভাব্য ঝুঁকি নিতে হবে। সুকুমার দেখিয়েছেন যে এমনকি জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্রে হাতির পছন্দমতো খাবার পাবার সুযোগ থাকলেও তারা কৃষিজমিতে হানা দেয় এবং ফসলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে (forage)। কারণ একই পরিমাণ চেষ্টায় তারা অনেকটা বেশি পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার সংগ্রহ করতে পারে ফসলের ক্ষেত থেকে। প্রাণীরা বুদ্ধিমান এবং নতুন নতুন সুযোগ উন্মুক্ত হলে তারা দ্রুত সুযোগগুলির উপযুক্ত ব্যবহার শিখে ফেলে। WLPA যেমন রয়েছে বন্যপ্রাণীরাও শিখে নিয়েছে কীভাবে নির্বিঘ্নে ফসলের ক্ষেতে হানা দিতে হবে অথবা লোকালয়ে হানা দিতে হবে কারণ মানুষ তাদের প্রতিহত করবে না। এর ফলশ্রুতিতে বন্যপ্রাণীদের জন্য অনেক বেশি খাবারদাবার সুলভ হয়ে যায়, আরও বেশি ক’রে তাদের বাড়তে সাহায্যও করে।

মানুষ-বন্যপ্রাণ সংঘাত

মানুষ-বন্যপ্রাণ দ্বন্দ্ব আজকের ভারতবর্ষে সর্বব্যাপী। ২০২১-এর মার্চ মাসে মধ্যপ্রদেশের মুখ্য বন্যপ্রাণ তত্ত্বাবধায়ক শ্রী এইচ এস পাবলা এবং বিখ্যাত সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী ডঃ এ জে টি জন সিং, সরকারের কাছে একটি নোট জমা দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি লিখেছিলেন, “মানুষবন্যপ্রাণ দ্বন্দ্ব ভারতে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটা বিরাট বড় সমস্যা। প্রত্যেক বছর প্রায় হাজার খানেক মানুষ মারা যায় হাতি, নেকড়ে, বাঘ, স্লথ ভল্লুক-এর হাতে, তার চেয়ে হাজারগুণ

23