পাতা:প্রকৃতি বনাম মানুষঃ একটি পরিকল্পিত সংঘাত - মাধব গাডগিল.pdf/৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 বাস্তুতান্ত্রিক বিচক্ষণতা

 ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের করুণ পরিণতির জন্য দায়ী এক ধরণের একচেটিয়া আগ্রাসন সম্পর্কে আমার কিছু ভাবনা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পেরে আমি আপ্লুত। আন্তর্জাতিক পর্যটনের আগ্রহেই এই আগ্রাসনটি ব্যাপকভাবে বিজ্ঞাপিত, প্রচারিত। এই আগ্রাসন বনদপ্তরের হাতকেই বহুদূর প্রসারিত করেছে। বনদপ্তর হল ব্রিটিশ শাসকদের তৈরি সংস্থা, যা এই দেশের গ্রাম-কৌমগুলির সার্বজনীন সম্পত্তিরূপী সম্পদগুলিকে দখল ক’রে প্রাকৃতিক সম্পদ নিঃশেষ করতে সাহায্য করেছে। ভারতীয় সমাজ ঐতিহ্যগতভাবে তার স্ব-কে প্রত্যক্ষ করেছে জৈবিক সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে। শুধুমাত্র অন্য মানুষদের অন্তর্ভুক্তি নয়, গাছপালা, অন্যান্য প্রাণী, এমনকি পাহাড় এবং নদীও যার অংশ। এই বিশ্বদৃষ্টির শিকড় প্রোথিত রয়েছে বেঁচে থাকার জন্য বাস্তুতান্ত্রিক কাজগুলি সম্পন্ন করতে কৌম-সম্প্রদায়ের সমস্ত অন্য সদস্যদের প্রয়োজনীতার কদর করায়, কৃতজ্ঞতা জানানোয়। এর প্রকাশ দেখা যায় রাজস্থানের ভরতপুরের কেওলাদেও ঘানা, তামিলনাড়ুর চেন্নাই-এর কাছে ভেদানথংগলে, কর্ণাটকের মাইসোর জেলার কোত্রে বেলুরে নানা ধরণের বক, সারস জাতীয় প্রাণী ও পেলিকান জাতীয় জলের পাখিদের প্রজনন বসতিগুলির সংরক্ষণের মধ্যে। এই প্রসূতি পাখিগুলি যদিও খুব সহজ শিকার ছিল কিন্তু অত্যন্ত যথাযথভাবেই প্রজননঋতুতে এদের রক্ষা করা হত, যাতে প্রজননের জন্য তারা বসতি স্থাপন করতে পারে। এরা চাষিদের খুব মূল্যবান সার উপহার দিত বছরের পর বছর। আবার প্রজনন ঋতুর বাইরে খুব আনন্দ করেই এই পাখিদের শিকার করা হত। বাস্তুশাস্ত্রবিদরা বলবেন এটি বিচক্ষণতার একটি খাঁটি উদাহরণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাবস্থাপকরা বলবেন স্থিতিশীল সদ্ব্যবহার। এই ধরণের বহু চর্চা ভারতে বহুক্ষেত্রেই শতকের পর শতক ধ’রে প্রচলিত, যা ভারতকে বন্যপ্রাণের সঙ্গে জড়িয়েজাপ্টে থাকা বৃক্ষরাজির এক মহাসমুদ্র হিসেবে গড়ে তুলেছিল; ব্রিটিশ শোষণে কৌমগত ব্যবস্থাপনা ধ্বংস হয়ে যাবার আগে পর্যন্ত।

 সামাজিক বিবাদ

 ভারতীয়রা হয়তো প্রকৃতির সঙ্গে শান্তিতেই বেঁচেবর্তে ছিল, তবে নিজেদের ভেতর আদৌ শান্তি ছিল না। সমাজের অভ্যন্তরে তীব্র বিবাদ ছিল; যা আজকের আধুনিক দিল্লির অদূরে খাণ্ডব অরণ্য দহনের মতো ঘটনায় চিত্রিত হয়েছে। মহাভারতের এই বিখ্যাত ঘটনার বর্ণনায় বলা আছে কৃষ্ণ, অর্জুনরা জঙ্গলের আশেপাশে কড়া নজর রেখেছিলেন। বেছে বেছে নাগা জনজাতির প্রত্যেককে এবং যেসব প্রাণীরা আগুনের জ্বলন্ত শিখা থেকে পালানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল, তাদের প্রত্যেককে হত্যা করেছিলেন। চূড়ান্ত অবিচারে ভরা, স্তরবিন্যস্ত ভারতীয় সমাজ কীভাবে গঠিত হয়েছিল, এটা তারই একটা যথযথ উদাহরণ। একমাত্র গৌতম বুদ্ধ যুক্তিবাদী এবং মানবতাবাদী ছিলেন, যিনি এইসমস্ত বৈষম্যের বিরোধিতা করেছিলেন, জ্ঞানের ওপর উচ্চবর্ণের একাধিপত্যেরও বিরোধিতা করেছিলেন। দুঃখজনকভাবে ভারতীয় সমাজে তাঁর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ভারতীয় সমাজ আবারও অবিচারপূর্ণ, একাধিপত্যকামী বিবাদে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আমাদের সিদ্ধান্তকে অনেক বেশি জোরালো করার কথা জ্ঞান এবং যুক্তির। তবে এগুলির কোনোটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। শেষ পর্যন্ত আমাদের মূল্যবোধই আমাদের পদক্ষেপগুলির দিশা নির্ধারণ করে। ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে, দেশের প্রগতিশীল সংবিধান মোতাবেক আমরা সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব এবং সামাজিক ন্যায়— এই মূল্যবোধগুলি মেনে চলতে

5