পাতা:প্রকৃতি বনাম মানুষঃ একটি পরিকল্পিত সংঘাত - মাধব গাডগিল.pdf/৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বাধ্য। তবে বর্তমান ভারতে প্রকৃতি সংরক্ষণের সন্দর্ভে যে দু’টি দর্শনের আধিপত্য, সেগুলি এই মূল্যবোধগুলিকে স্পষ্টতই নাকচ করছে। এর মধ্যে প্রথমটি হল ‘সর্বাগ্রে বন্যপ্রাণ’-এর দর্শন; যা বলে— বড় স্তন্যপায়ী এবং পাখি সংরক্ষণ করতে হবে সাধারণ মানুষ তথা অন্য সমস্ত কিছুর কল্যাণের মূল্যের বিনিময়ে। অন্য দর্শনটি বলে— সবরকম মূল্যের বিনিময়েই আমাদের জিডিপি বৃদ্ধির নামান্তর ‘উন্নয়ন’-এর প্রচার করা উচিত। এই সমস্ত মূল্যই অবশ্যম্ভাবীভাবে চেপে বসেছে দুর্বলতর অংশের মানুষের ওপর এবং প্রাকৃতিক পুঁজির ওপর। দু’টি দর্শনই মানুষকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেয়। মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধেও লড়িয়ে দেয়। দু’টি দর্শনকেই প্রত্যাখ্যান করা উচিত এবং তৃণমূল স্তরের মানুষের বাস্তুতান্ত্রিক বিচক্ষণতাকেই আঁকড়ে ধরা উচিত, যারা প্রকৃতির বাস্তুতান্ত্রিক সেবার প্রকৃত মূল্য দিচ্ছেন এবং তাকে রক্ষা করছেন। আমাদের প্রচেষ্টা থাকা উচিত অনেক বেশি সাম্যমুখী এবং সামাজিক ন্যায়পূর্ণ এক সমাজ গড়ার।

 ১৯৭২-এর স্টকহোম সম্মেলন

 পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নটি প্রথম বিশ্ব সন্দর্ভের কেন্দ্রে আসে ১৯৭২ সালের স্টকহোম সম্মেলনে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেই সম্মেলনে আবেগমথিত বক্তৃতায় বলেন— দারিদ্র হল প্রধান দূষক, ভারতের উন্নয়নী নীতি দারিদ্র দূর করবে। যার ফলশ্রুতিতে পরিবেশের রক্ষণাবেক্ষণ হবে। কিন্তু ১৯৭২-এ কার্যক্ষেত্রে, বাস্তবের মাটিতে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ কী ছিল? শুধুমাত্র বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন (Wildlife Protection Act (WLPA))-এর ঘোষণা এবং ব্যাঘ্র প্রকল্পের অবতারণা। দু’টিই বাস্তবে সাধারণ মানুষের দারিদ্র না কমিয়ে, বাড়িয়েছে এবং পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালেই গাড়োয়াল হিমালয়ে চিপকো আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। চিপকো আন্দোলন দাবি তুলেছিল বাণিজ্যিক প্রয়োজনে যেন হিমালয়ের বৃক্ষরাজির বৃদ্ধি রোধ করা না হয়। সাধারণ মানুষের জীবনধারণের জন্য এবং বন্যা এবং ধস থেকে বাঁচার জন্য যেন অন্তত গাছেদের রেহাই দেওয়া হয়। জঙ্গলগুলি যেন সাধারণ মানুষের জীবনধারণ, পরিবেশের সুরক্ষা এবং দেশের জন্য মাটি আর জলের যোগান দিয়ে যেতে পারে।

 ব্রিটিশ অভিজ্ঞতা

 চিপকো আন্দোলনকারীদের প্রশংসা করতে গেলে এবং তাদের দাবিগুলিকে সরকারের আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়ার পদক্ষেপকে বুঝতে হলে জঙ্গল ও বন্যপ্রাণ ব্যবস্থাপনা বিষয়টির পূর্ববর্তী ঘটনাপ্রবাহ খতিয়ে দেখতে হবে। ব্রিটেনের বেশীরভাগ অরণ্য ও বেশ বড় সংখ্যক বন্যপ্রাণ হারিয়ে গেছে তাদের ভারত বিজয়ের কয়েক শতক আগেই। প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল ১০৬৬ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট উইলয়ামের সময়ে। সম্রাট উইলিয়াম শিকার করতে ভালোবাসতেন, তিনিই অরণ্য আইন প্রতিষ্ঠা এবং লাগু করেছিলেন। এই আইন সাধারণ আইনের আওতার বাইরে সক্রিয় ছিল। আইনটি সাধারণ ইংরেজদের শিকারের হাত থেকে ক্রীড়া-পশু ও তাদের বাসস্থান সংরক্ষণের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। অতঃপর, রাজ-অরণ্যে সাধারণের শিকার করাই অবহিত হল ‘পোচিং’ হিসেবে, শাস্তি ছিল ফাঁসি। ১০৮৬ সালে, তিনি সারা দেশের সমস্ত ভূমিখণ্ডকে কিছু সামন্ত প্রভুর মধ্যে ভাগ করে দেন। এই সামন্ত প্রভুরাও সম্রাট উইলিয়ামের দেখানো পথেই হাঁটলেন। সাধারণ মানুষের জমি দখল করলেন। জমিগুলো ঘিরে

6