পাতা:প্রকৃতি বনাম মানুষঃ একটি পরিকল্পিত সংঘাত - মাধব গাডগিল.pdf/৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ফেললেন এবং সাধারণ মানুষকে তাদের কৌমভূমি চাষাবাদের অধিকার, শিকারের অধিকার ও পশুচারণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করলেন। অর্থাৎ, ব্রিটেন এমন এক ব্যবস্থার প্রচলন করল, যেখানে সমস্ত ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত এবং কৌম-নিয়ন্ত্রণ অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইল। পরবর্তী দুই শতক ধরে চলা কৃষক প্রতিবাদ কড়া হাতে দমন করা হয়েছিল। ফল হয়েছিল সর্বনাশা। ব্রিটেন তার অনেকখানি বনাঞ্চল ও অজস্র বন্য পশু হারিয়েছিল চতুর্দশ শতকের মধ্যেই।

 ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি

 ব্রিটিশরা মারাঠা নৌসেনাদের তাগড়াই সেগুন কাঠের জাহাজ দেখেছিল। তারা তাদের দেশের প্রায় নিঃশেষিত ওক গাছের বদলে এই কাঠ ব্যবহার করতে চাইছিল। ১৭৯৯ সালে তারা টিপু সুলতানকে পরাজিত করে এবং দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। তারা টিপুর শাসনাধীন সমগ্র অঞ্চলে রাজা হিসেবে চন্দন কাঠের ওপর টিপুর স্বত্ত্বকে অনুকরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ইংরেজরা ভারতের বনজ সম্পদ ব্যবহারের জন্য দ্বিমুখী কৌশল নিয়েছিল। একটি হল কৌমভূমিকে রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত করা, দ্বিতীয়টি হল সরাসরি সমস্ত সেগুন গাছকে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সম্পত্তি হিসেবে দাবি করা। সে সময় পবিত্র বনাঞ্চলের এক প্রকার অন্তর্জাল সারা দেশেই ছেয়ে ছিল। মারাঠাদের সেগুন বৃক্ষসৃজনের মতো এটিও ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু ব্রিটিশরা চাষিদের জমি থেকে সেগুন গাছ কাটতে শুরু করলে তুমুল শোরগোল প’ড়ে যায়, যার জেরে ১৮২৫ খ্রীষ্টাব্দে তারা তাদের বনকেন্দ্রিক সংস্থান বন্ধ করতে বাধ্য হয়। পরবর্তী তিন দশক ছিল সারা দেশজোড়া লাগামহীন বৃক্ষচ্ছেদনের সময়।

 অরণ্য ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলাবদ্ধকরণ

 ১৮৫৭ সালের যুদ্ধের পর ব্রিটিশদের কাছে বেশ বড়সড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির নীতির কারণে যে ব্যাপক বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছিল, তা থেকে উদ্ভূত অসন্তোষ সামাল দেওয়া। তাই, তারা এই সমস্যার সমাধান করলো একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ অরণ্য ব্যবস্থাপনার সূচনার মধ্যে দিয়ে। প্রশ্নটা ছিল এই উদ্দেশ্যের জন্য প্রয়োজনীয় বোঝাপড়াটি এলো কোথা থেকে? ব্রিটিশরা তাদের নিজেদের বনাঞ্চল ধ্বংস করেছে। তাদের দেশে বন ব্যবস্থাপনার কোনো ঐতিহ্যই ছিল না। তারা জোর ক’রে তখনও পর্যন্ত ইউরোপের বাকি যে অংশটুকু বনাচ্ছাদিত ছিল, সেখানেও একই ঘটনা ঘটালো। এক্ষেত্রেও আরেকটা খুব বড় পার্থক্য ছিল। ইউরোপের বিভিন্ন অংশে তখনও কৌম মালিকানা ছিল। যার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হল স্যুৎজারল্যাণ্ড। এই পাহাড়ি দেশের বনাঞ্চলের একটা বড় অংশ ধ্বংস হয়েছে ১৮৬০-এর দশকে। কিন্তু ভূমিধসের জন্য প্রচুর জমি ধ্বংস শুরু হ’লে, মানুষ জেগেছিলেন এবং অরণ্য বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এখন সেখানে দুর্দান্ত বনাচ্ছাদন (forest cover) রয়েছে। সবক’টির মালিকানাই স্থানীয় কৌমের, কোনোটিই রাষ্ট্রের বনদপ্তরের অধীন নয়।

 স্থানান্তরী চাষ নিষিদ্ধ হল

 কোনো ইংরেজকে না পেয়ে, ব্রিটিশরা জার্মান উদ্ভিদবিজ্ঞানী দিয়েত্রিচ ব্র্যাণ্ডিসকে ডেকে আনে নব্যস্থাপিত বনাকেন্দ্রিক সংস্থানের জন্য। ব্র্যাণ্ডিস-এর কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল— গ্রামের কৌম সম্প্রদায় বন ব্যবস্থাপনায় কতটা অংশ নেবে আর রাষ্ট্র কতটা সম্পদ হিসেবে

7