পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/১০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

>98 কিছু দূরে গাড়িতে র্তাহার মেম পরেশবাবুর মেয়েদের লইয়া হাওয়া থাইতে বাহির হইয়াছেন। ব্রাউনলো সাহেব গার্ডন পার্টিতে মাঝে মাঝে বাঙালী ভদ্রলোকদিগকে তাহার বাড়িতে নিমন্ত্ৰণ করিতেন। জিলার এণ্টে স স্কুলে প্রাইজ বিতরণ উপলক্ষ্যে তিনিই সভাপতির কাজ করিতেন। কোনো সম্পন্ন লোকের বাড়িতে বিবাহাদি ক্রিয়াকৰ্ম্মে তাহাকে আহবান করিলে তিনি গৃহকর্তার অভ্যর্থনা গ্রহণ করিতেন। এমন কি, যাত্রাগানের মজলিষে আহত হইয়া তিনি একটা বড় কেদারায় বসিয়া কিছুক্ষণের জন্য ধৈর্য্যসহকারে গান শুনিতে চেষ্টা করিতেন। তাহার আদালতের গভৰ্মেণ্টপ্লীডারের বাড়িতে গত পূজার দিন যাত্রা দেখিয়া, যে দুই ছোকরা ভিস্তি ও মেৎরাণী সাজিয়াছিল, তাহাদের অভিনয়ে তিনি বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করিয়াছিলেন এবং তাহার অনুরোধক্রমে একাধিকবার তাহাদের অংশ তাহার সম্মুখে পুনরাবৃত্ত হইয়াছিল। তাহার স্ত্রী মিশনরির কন্যা ছিলেন। তাহার বাড়িতে মাঝে মাঝে মিশনরি মেয়েদের চা-পান সভা বসিত। জেলায় তিনি একটি মেয়ে ইস্কুল স্থাপন করিয়াছিলেন এবং যাহাতে সেই স্কুলে ছাত্রীর অভাব না হয় সে জন্ত তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করিতেন। পরেশবাবুর বাড়িতে মেয়েদের মধ্যে বিস্তাশিক্ষার চর্চা দেখিয়া তিনি তাহাদিগকে সৰ্ব্বদা উৎসাহ দিতেন ; দূরে থাকিলেও মাঝে মাঝে চিঠি পত্র চালাইতেন ও ক্রিষ্টমাসের সময় তাহাদিগকে ধৰ্ম্মগ্রন্থ উপহার পাঠাইতেন। মেলা বসিয়াছে। তদুপলক্ষ্যে হারানবাবু, সুধীর ও বিনয়ের সঙ্গে বরদাসুন্দরী ও মেয়েরা সকলেই আসিয়াছেন–র্তাহাদিগকে ইনস্পেক্শন বাংলায় স্থান দেওয়া হইয়াছে। পরেশবাবু এই সমস্ত গোলমালের মধ্যে কোনোমতেই থাকিতে পারেন না এই জন্ত তিনি একলা কলিকাতাতেই রহিয়া গিয়াছেন। স্বচরিতা তাহার সঙ্গরক্ষার জন্য র্তাহার কাছে থাকিতে অনেক চেষ্টা পাইয়াছিল কিন্তু পরেশ, ম্যাজিষ্ট্রেটের নিমন্ত্রণে কৰ্ত্তব্যপালনের জন্য, সুচরিতাকে বিশেষ উপদেশ দিয়াই পাঠাইয়া দিলেন। আগামী পরশ্ব কমিশনার সাহেব ও সস্ত্রীক ছোট লাটের সম্মুখে ম্যাজিষ্ট্রেটের বাড়ীতে প্রবাসী । [ ৮ম ভাগ। ডিনারের পরে ঈভনিং পার্টতে পরেশবাবুর মেয়েদের tি অভিনয় আবৃত্তি প্রভৃতি হইবার কথা স্থির হইয়াছে—সেম্বর ম্যাজিষ্ট্রেটের অনেক ইংরেজ বন্ধু জেলা ও কলিকাতা ষ্টা আহত হইয়াছেন। কয়েকজন বাছা বাছা বাঙালী ভদ্ধ লোকেরও উপস্থিত হইবার আয়োজন হইয়াছে। তাহলে জন্য বাগানে একটি তাবুতে ব্রাহ্মণ পাচক কর্তৃক প্রস্থ জলযোগেরও ব্যবস্থা হইবে এইরূপ শুন যাইতেছে। হারানবাবু অতি অল্পকালের মধ্যেই উচ্চভাবের আলাপ ম্যাজিষ্ট্রেট্‌ সাহেবকে বিশেষ সন্তুষ্ট করিতে পারিয়াছিলেন। খৃষ্টান ধৰ্ম্মশাস্ত্রে হারানবাবুর অসামান্ত অভিজ্ঞতা দেখিা সাহেব আশ্চৰ্য্য হইয়া গিয়াছিলেন এবং খৃষ্টান ধৰ্ম্ম গ্রহণে তিনি অল্প একটু মাত্র বাধা কেন রাখিয়াছেন এই প্রশ্নং হারানবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন। আজ অপরাহ্লে নদীতীরের পথে হারানবাবুর সঙ্গে তিনি ব্রাহ্মসমাজের কার্য্যপ্রণালী ও হিন্দুসমাজের সংস্কারসা সম্বন্ধে গভীর ভাবে আলোচনায় নিযুক্ত ছিলেন। এমন সন্ম গোরা “গুড় ঈভনিং স্তর” বলিয় তাহার সম্মুখে আদি দাড়াইল । কাল সে ম্যাজিষ্ট্রেটের সহিত দেখা করিবার চেষ্টা করিান্ত গিয়া বুঝিয়াছে যে সাহেবের চৌকাঠ উত্তীর্ণ হইতে গোল তাহার পেয়াদার মাশুল জোগাইতে হয়। এরূপ দণ্ড ও অপমান স্বীকার করিতে অসম্মত হইয়া আজ সাহেবের হাওয়া থাইবার অবকাশে সে র্তাহার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছে। এই সাক্ষাৎকালে হারানবাবু ও গোর, উত্ত পক্ষ হইতেই পরিচয়ের কোনো লক্ষণ প্রকাশ হইল না। লোকটাকে দেখিয়া সাহেব কিছু বিক্ষিত হয়৷ গেলেন। এমন ছয়ফুটের চেয়ে লম্বা, হাড়মোটা, মঙ্গুং মানুষ তিনি বাংলা দেশে পূৰ্ব্বে দেখিয়াছেন বলিয়া মনে করিতে পারিলেন না। ইহার দেহের বর্ণও সাধার বাঙালীর মত নহে । জামা, ধুতি মোটা ও মলিন, হাতে এক গাছ বাশের গঠি চাদর থানাকে মাথায় পাগড়ির মত বাধিয়াছে। গোর ম্যাজিষ্ট্রেটকে কহিল—“আমি চর ঘোষণু } হইতে আসিতেছি।” ম্যাজিষ্ট্রেট একপ্রকার বিস্ময়সূচক শিষ দিলেন। বোধ গায়ে একখানা থাকী রঙের পাঞ্জাবী | }র্থ সংখ্যা | | . দুর তদন্ত কার্য্যে একজন বিদেশী বাধা দিতে আসিয়াছে লসংবাদ তিনি গত কল্যই পাইয়াছিলেন। তবে এই লোকটাই সে! গোরাকে আপাদমস্তক তীক্ষ ভাবে একবার নিরীক্ষণ করিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন—“তুমি কো জাত ?” গোর কছিল, “আমি বাঙালী ব্রাহ্মণ ।” সাহেব কছিলেন, “ও । খবরের কাগজের সঙ্গে তোমার রোগ আছে বুঝি ?” . গোরা কহিল—“না ।" ম্যাজিষ্ট্রেট কহিলেন, “তবে ঘোষপুর চরে তুমি কি করতে এসেছ ?” গোরা কহিল, “ভ্রমণ করতে করতে সেখানে আশ্রয় লিছিলুম-পুলিশের অত্যাচারে গ্রামের দুৰ্গতির চিহ্ন দেখে এবং আরো উপদ্রবের সম্ভাবনা আছে জেনে প্রতিকারের জন্য আপনার কাছে এসেছি।” ম্যাজিষ্ট্রেট কহিলেন,—“চর ঘোষপুরের লোক গুলো অত্যন্ত বদমায়েস সে কথা তুমি জান ?” গোরা কহিল,—“তারা বদমায়েস নয়, তারা নির্ভীক স্বাধীনচেত। —তারা অন্যায় অত্যাচার নীরবে সহ করতে পারে না।” ম্যাজিষ্ট্রেট চটিয়া উঠিলেন। তিনি মনে মনে ঠিক করিলেন নব্য বাঙালী ইতিহাসের পুথি পড়িয়া কতকগুলা #fforts—Insufferable "এখানকার অবস্থা তুমি কিছুই জান না” বলিয়া মাজিষ্ট্রেট গোরাকে খুব একটা ধমক দিলেন। "আপনি এখানকার অবস্থা আমার চেয়ে অনেক কম জানেন" গোর মেঘমন্দ্র স্বরে জবাব করিল। ম্যাজিষ্ট্রেট কহিলেন,—“আমি তোমাকে সাবধান করে দ্বাচ্চ তুমি যদি ঘোষপুরের ব্যাপার সম্বন্ধে কোনোপ্রকার স্তক্ষেপ কর তাহলে খুব সস্তায় নিস্কৃতি পাবে না।” গোরা কহিল—“আপনি যখন অত্যাচারের প্রতিবিধান করবেন না বলে মনস্থির করেছেন এবং গ্রামের লোকের বিরুদ্ধে আপনার ধারণা যখন বদ্ধমূল, তখন আমার আর কোনো উপায় নেই—আমি গ্রামের লোকদের নিজের চেষ্টা পুলিসের বিরুদ্ধে দাড়াবার জন্তে উৎসাহিত করব।” - গোরা। - शाबिडे निड চলিতে হঠাত থামিয়া দাড়াইয়া ➢ ጫ¢ বিদ্যুতের মত গোরার দিকে ফিরিয়া গর্জিয়া উঠিলেন“কি ! এত চড় স্পৰ্দ্ধা !” গোর দ্বিতীয় কোনো কথা না বলিয়া ধীরগমনে চলিয়া গেল। ম্যাজিষ্ট্রেটু কহিলেন, "হারানবাবু, আপনাদের দেশের লোকদের মধ্যে এ সকল কিসের লক্ষণ দেখা যাইতেছে ?” হারানবাবু কহিলেন, “লেখাপড়া তেমন গভীরভাবে হইতেছে না, বিশেষত দেশে আধ্যাত্মিক ও চারিত্র-নৈতিক শিক্ষা একেবারে নাই বলিয়াই এরূপ ঘটিতেছে। ইংরেজি বিদ্যার যেটা শ্রেষ্ঠ অংশ সেটা গ্রহণ করিবার অধিকার ইহাদের হয় নাই। ভারতবর্ষে ইংরেজের রাজত্ব যে ঈশ্বরের বিধান এই অকৃতজ্ঞরা এখনো তাহা স্বীকার করিতে চাহিতেছে না তাহার একমাত্র কারণ ইহার কেবল পড়ামুখস্থ করিয়াছে কিন্তু ইহাদের ধৰ্ম্মবোধ নিতান্তই অপরিণত । ম্যাজিষ্ট্রেটু কহিলেন “খুষ্টকে স্বীকার না করিলে ভারতবর্ষে এই ধৰ্ম্মবোধ কখনই পূর্ণতালাভ করিবে না।” হারানবাবু কহিলেন, “সে কথা এক হিসাবে সত্য।” এই বলিয়৷ খৃষ্টকে স্বীকার করা সম্বন্ধে একজন খৃষ্টানের সঙ্গে হারানবাবুর মতের কোন অংশে কতটুকু ঐক্য এবং কোথায় অনৈক্য তাহাই লইয়া হারানবাবু ম্যাজিষ্ট্রেটের সহিত সূক্ষ্মভাবে আলাপ করিয়া তাহাকে এই কথাপ্রসঙ্গে এতই নিবিষ্ট করিয়া রাখিয়াছিলেন যে, মেমসাহেব যখন পরেশবাবুর মেয়েদিগকে গাড়ি করিয়া ডাকবাংলায় পৌছাইয়া দিয়া ফিরিবার পথে তাহার স্বামীকে কহিলেন, “হারি, ঘরে ফিরিতে হইবে”—তিনি চমকিয়া উঠিয়া ঘড়ি খুলিয়া কহিলেন, “বাই জোভ, আটটা বাজিয়া কুড়ি মিনিট!” গাড়িতে উঠিবার সময় হারানবাবুর কর নিপীড়ন করিয়া বিদায়সম্ভাষণ-পূৰ্ব্বক কহিলেন, আপনার সহিত আলাপ করিয়া আমার সন্ধ্যা খুব মুখে কাটিয়াছে। 3. হারানবাবু ডাকবাংলায় ফিরিয়া আসিয়া ম্যাজিষ্ট্রেটের সহিত তাহার আলাপের বিবরণ বিস্তারিত করিয়া বলিলেন। কিন্তু গোরার সহিত সাক্ষাতের কোনো উল্লেখমাত্র করিলেন ন।