পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/১৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জেমস রেনেল, এফ, আর, এস, সাহেব ঢাকার ও তন্নিকটবৰ্ত্তী স্থানসমূহের যে ম্যাপ অঙ্কিত করেন তাহাতেও এস্থানে কোনও নদীর উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় না। সে সময়ে পদ্মানদী ঢাকা জেলার দক্ষিণ পশ্চিম দিক দিয়া প্রবাহিত হইয়া বাখরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত মেহেদিগঞ্জ নামক স্থানে মেঘনা বা মেঘনাদ নদীর সহিত সম্মিলিত হইয়াছিল। তখন রাজনগরের মধ্য দিয়া পূৰ্ব্ব ও পশ্চিম দিকে একটা খাল থাকায় এস্থানে নানাবিধ দ্রব্যের আমদানি ও রপ্তানি হইত। একদিকে যেমন স্বন্দর সুন্দর অট্টালিকা ও “রাজসাগর”, “পুরাতন দীঘি", “কালীসাগর”, “কৃষ্ণসাগর”, “মতিসাগর”, “শিব পাড়ার দীঘি” প্রভৃতি ক্ষুদ্র ও বৃহৎ জলাশয় সমূহ এস্থানের সৌন্দৰ্য্য বৃদ্ধি করিত অন্ত দিকে আবার তেমনি “নারিকেলতা", “মান্দারিয়া", "চাকলাদার পল্লী,” “ভরদ্বাজ পল্লী", "রাইয়তপাড়া” প্রভৃতি জনপূর্ণ পল্লীসমূহ থাকায় রাজনগর গ্রাম সৰ্ব্বদাই আমোদ-কোলাহল-মুখরিত থাকিত। সেকালে সাধারণতঃ সকলেরই অবস্থা ভাল ছিল, খাওয়া পরার চিন্তা বড় কাহাকেও একটা করিতে হইত ন, সকলের ঘরেই মরাই-ভরা ধান থকিত, কাজেই সকলে হয় লাঠি তরোয়াল খেলা নয়ত গান বাজনা প্রভৃতি নির্দোষ আমোদে দিন কাটাইত। এই নিমিত্তই সেকালের রাজনগর গ্রামে বর্তমানের ভয়ঙ্করী অন্নচিস্তায় কাহাকেও ব্যতিব্যস্ত থাকিতে হইত না। এস্থানে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ, কামার, কুমার, গোপ, মালাকার, কাংস্তবণিক, গদ্ধবণিক, তত্ত্ববায় প্রভৃতি বঙ্গীয় হিন্দু-সমাজের যত বিভিন্ন শ্রেণীস্থ লোকের বাস ছিল তদ্রুপ বর্তমান সময়েও বিক্রমপুরের কোনও বদ্ধিষ্ণু গ্রামে এত বিভিন্ন শ্রেণীস্থ লোকের বাস পরিলক্ষিত श्ब्र'नां । সেকালের রাজনগরবাসিগণের কেবল যে আমোদ প্রমোদ ও ব্যায়ামের প্রতি লক্ষ্য ছিল তাহা নহে, শিক্ষার প্রতিও তাহাদের বিশেষ মনোযোগ ছিল । জন-সাধারণের মধ্যে যাহাতে শিক্ষা প্রচারিত হয় সে বিষয়ে তাহারা বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। ছোট বড় সকলেই যাহাতে শিক্ষা লাভ করিয়া নিজ নিজ অবস্থার উন্নতি ও সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান লাভ করিতে পারে এবিষয়ে তাহারা সবিশেষ প্রবাসী । --്.--പ് [ ৮ম ভাগ। মনোযোগ করতেন। রাজনগরের প্রতি পল্লীতেই বলে শিক্ষার জন্য পাঠশালা, পারস্ত ভাষা শিক্ষা করিবার জন্ম মক্তব ও সংস্কৃত শিক্ষার্থ চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠিত ছিল। অভি.1 ভাবকগণ নিজ নিজ রুচি অনুসারে স্বীয় স্বীয় সন্তানগণকে | স্বশিক্ষিত করিতেন। তবে পারসী ও সংস্কৃতের আদী ৷ বেশী ছিল, বালকেরা সামান্ত বাংলা শিক্ষা করিয়া সকলেই মৌলভির নিকট পারসী ভাষায় শিক্ষা লাভার্থ দুইবেল পুথি হস্তে অধ্যয়ন করিতে যাইত। অন্তঃপুরেও শিক্ষা দ্বার অবরুদ্ধ ছিল না। যদি তাহা হইত, তাহা হইলে । বিদুষী আনন্দময়ী ও গঙ্গাদেবীর স্বমধুর কবিত্বথা। বর্তমান বিদুষী মহিলাগণও গোঁববান্বিতা বোধ করিড়ে না। শ্ৰীযুক্তবাবু দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় তাহার স্বপ্রদি “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” নামক গ্রন্থেও এই বিদুষী কবিদ্বয়ে কথা বিশেষরূপে উল্লেখ করিয়াছেন । বিধাতার আশ্চর্যা বিধান হৃদয়ঙ্গম কর। মানববুদ্ধির অগোচর। বিক্রমপুরবাসীর দুর্ভাগ্য তাই ১২৭৬ মান কীৰ্ত্তিনাশার তরঙ্গ-প্রচারে রাজনগর চিরদিনের জন্য লোক লোচনের অদৃশু হইয়াছে। আমরা এ প্রবন্ধে সংক্ষেণে রাজনগরের দ্রষ্টব্য জলাশয় গুলি ও ইমারতাদির বিবরণ প্রদান করিলাম। ভরসা করি পাঠকগণ ইহা হইতে । মহারাজা রাজবল্লভের বাসগ্রামের একটা ছায়া-চিত্র হৃদয়ে অনুভব করিতে পারিবেন। . রাজনগরের বক্ষভেদ করিয়া যে খালটি পূৰ্ব্ব হইত্তে পশ্চিমদিকে প্রবাহিত ছিল, সেই খাল ধরিয়া পূৰ্ব্বদিকে কিছুদূর অগ্রসর হইলেই “রাজসাগর” নামক একটা হ্রদের ন্তায় প্রকাও সরোবর দৃষ্টিপথে পতিত হইত। এই জল শয়ের জল অত্যন্ত নিৰ্ম্মল ও সুপেয় ছিল । ইহার চারি তীরেই ইষ্টকনিৰ্ম্মিত সোপানাবলী থাকায় জনপদ-বধূগণের জল লইবার পক্ষে বিশেষ সুবিধা ও সুযোগ ছিল। এই সরোবরের উত্তর তীরে ‘রাজসাগরের হাট’ নামক রাজনগরের সুবিখ্যাত বন্দর থাকায় এস্থান সৰ্ব্বদাই জন কোলাহলে মুখরিত থাকিত। সেকালের সভ্যতা ও রুচি অনুযায়ী এই হাটে সমুদয় দ্রব্যই পাওয়া যাইত। বন্দরের ভিতরে বহু রাস্তা এবং নানাবিধ পণ্যদ্রব্যের দোকান ছিল। জগন্নাথদেব? প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। রাজসাগরের পশ্চিমতটে স্থপতিকৌশলের নিদর্শন স্বরূপ । ৫ম সংখ্যা । ] নানা কারু-কাৰ্য্য-খচিত দুইটি দেব-মন্দির প্রতিষ্ঠিত ছিল, তাহার একটিতে “মহাপ্রভূ” নামক দেবতা ও অপরটিতে প্রতিদিন বোড়শোপচারে এই বিগ্রহের অৰ্চ্চনা ও যথারীতি প্রাতে সন্ধ্যায় শঙ্খ ঘণ্টার গগন-ভেদী নিনাদে আরতি হইত। এই সরোবরের অন্যান্য তীরে নানাজাতীয় বণিকৃবৃন্দ পরমানন্দে বাস করিত। এই সরোবরের বৃহত্ত্ব সম্বন্ধে একথা বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে দি ইহার এক তীর হইতে বন্দুকের আওয়াজ করা যাষ্টত তবে অপরতীর হইতে তাহ শুনা যাইত না। মৃদ্ধ পবন ম্পর্শেই ইহার বক্ষে তরঙ্গনিচয় উত্থিত হইয়া ক্রীড়া করিত। পুরাতন দীঘি। আমরা পূৰ্ব্বে যে পথের উল্লেখ করিয়াছি সেই পথ অনুসরণ করিয়া প্রায় এক মাইল পৰ্য্যস্ত পশ্চিমদিকে অগ্রসর হইলে পুরাতন দীঘি নয়ন-গোচর হইত। রাজসাগর অপেক্ষা ইহা আয়তনে ছোট ছিল। এই দীঘির পশ্চিমতটে চৈত্রসংক্রাস্তি হইতে আরম্ভ করিয়া জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ তারিপ পর্য্যন্ত দুইমাস কাল স্থায়ী একটি মেলা বসিত। এই মেলা “কাল-বৈশাখীর মেলা” বলিয়া বিখ্যাত ছিল। ঢাকা জেলাস্থ উত্তর বিক্রমপুরের কাৰ্ত্তিকবারুণীর মেলা অপেক্ষা ইহার খ্যাতি ও প্রতিপত্তি কম ছিল না। প্রাচীন ব্যক্তিদের মুখে অবগত হওয়া যায় যে এই স্থানে চড়ক পূজায় যেরূপ সমারোহ হইত পূৰ্ব্ববঙ্গের আর কোথাও সেরূপ হইত না। শতাধিক ঢাকের প্রচও নিনাদে হৃদয়ে এক আশ্চর্যা ভাবের উদয় হইত। এক বিশাল চড়ক বৃক্ষে ষোড়শ সংখ্যক বলিষ্ঠ যুবক একত্র ঘূর্ণিত হইত, তাহাদিগকে উৎসাহিত করিবার জন্য চতুর্দিকস্থ অগণন দর্শকবৃন্দের কল-কোলাহল ও ঢাকের ভীষণ শব্দে চতুর্দিক প্রতিধ্বনিত করিয়া তুলিত। পুরাতন দীঘি ছাড়াইয়া কিয়দর অগ্রসর হইলেই সম্মুখে মহারাজা রাজবল্লভের জ্যেষ্ঠভ্রাতার পুত্র রায় মৃত্যুঞ্জয়ের বাটীর তোরণ দ্বার দৃষ্টি অবরোধ করিত। রাজবল্লভের মৃত্যুর পরে রায় মৃত্যুঞ্জয়ই রাজনগরের মধ্যে ধনে, মানে শ্ৰেষ্ঠ ছিলেন। মৃত্যুঞ্জয়ের আবাসবাটও নানারূপ সুন্দর সুন্ধর অট্টালিকা সমূহে পরিশোভিত ছিল। পুরাতন রাজনগর । ২৮৫ দীঘির পশ্চিমতীরের উত্তর দিক হইতে একটি রাস্তা বরাবর পশ্চিমদিকে গিয়াছিল। এই পথের পাশ্বে স্থানে স্থানে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ বহু সরোবর ছিল, সে সকলের বিস্তৃত বিবরণ অনাবশ্যক। এই পথটি রাজনগরের “পুরাতন দরজা” নামে অভিহিত ছিল । ইহার পশ্চিমদিকে রাজা রাজবল্লভের পিতা কৃষ্ণজীবন মজুমদারের বাড়ী ছিল। এখানে বহু ছোট বড় আটালিকা বিদ্যমান ছিল, কিন্তু তন্মধ্যে “নবরত্ন” নামক রমণীয় প্রাসাদটির কথাই বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য। নবরত্ন । একটি চতুষ্কোণ একতল অটালিকার হলের চারিদিকে চারিটি ও প্রত্যেক কোণে এক একটি চতুষ্কোণ মঠ ও দুইটি মঠের প্রত্যেকটির মধ্যভাগে এক একটি “ঝিকটি ঘর” (যে ঈষ্টকনিৰ্ম্মিত গৃহের দোচালা ঘরের ন্যায় চাল) সন্নিবিষ্ট। ছাতের মধ্যস্থলে যে মঠটি ছিল তাহার উচ্চতা চতুৰ্দ্দিকস্থ ঝিকটি ঘর হইতে অধিক ও মাটি হইতে প্রায় শতাধিক হাত উচ্চ ছিল। এই অট্টালিকা ইষ্টক ও প্রস্তরে নিৰ্ম্মিত এবং উহার প্রাচীরের গায়ে নানা প্রকার লতা, পাতা ও ফুল ফল অঙ্কিত থাকায় ইহা বড়ই স্বন্দর দেখাইত। একবিংশ রত্ন । ইহাই রাজা রাজবল্লভের বাড়ীর সিংহ দরজা বা তোরণদ্বার ছিল। পুরাণ দীঘির পশ্চিমতটস্থ স্বপ্রশস্ত রাজপথ ধরিয়া কিয়দর অগ্রসর হইলেই এই স্ববিশাল তোরণদ্বার দৃষ্টিগোচর হইত। এই তোরণদ্বার একটি ত্রিতল অট্টালিকা। প্রথম তলের নিম্নে সিংহদ্বার, ইহার ছাত অৰ্দ্ধবৃত্তাকারে নিৰ্ম্মিত ছিল এবং ইহার নিম্নস্থ পথ এতদূর সুপ্রশস্ত ছিল যে তাহার মধ্য দিয়া অনায়াসে তিনটি হস্তী - হাওদাসহ পাশাপাশিভাবে যাতায়াত করিতে পারিত। এই দ্বারের দুই দিকে দুইটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বেদী ছিল, উহাদের উপর দণ্ডায়মান হষ্টা দিবারাত্রি দেীবারিকগণ প্রহরায় নিযুক্ত থাকিত । . এই তোরণদ্বারপাশ্বস্থ উভয়দিকের একতল আটালিকার মধ্যে অনেকগুলি প্রকোষ্ঠ ছিল। সে সকল প্রকোষ্ঠে রাজকীয় সৈন্তগণ বাস করিত। এই একতল মটালিকার ছাতের প্রতি কোণে এক একটি মঠ ও সন্মুখস্থ দুই মঠের