পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/১৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রবাসী । ...] ৬ষ্ঠ সংখ্যা । ] গোরা । SMMMMMMSMMSMMSMMSMMSMMSMSMS ২৯৮ *నసి নিদ্রিত। আর কিছু নয়, এই সুন্দর, এই বিশ্বাসপূর্ণ নিদ্রাটুকুকেই ললিতা আজ বিনয়ের হাতে সমর্পণ করিয়া দিয়াছে। এই নিদ্রাটুকুকে বিনয় মহামূল্য রত্নটির মত রক্ষা করিবার ভার লইয়াছে। পিতামাত ভাই ভগিনী কেহই নাই, একটি অপরিচিত শয্যার উপর ললিতা আপন সুন্দর দেহখানি রাখিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া ঘুমাইতেছে—নিশ্বাসপ্রশ্বাস যেন এই নিদ্রাকাব্যটুকুর ছন্দ পরিমাপ করিয়া অতি শান্তভাবে গতায়াত করিতেছে, সেই নিপুণ কবরীর একটি বেণীও বিস্রস্ত হয় নাই, সেই নারীহৃদয়ের কল্যাণ-কোমলতায় মণ্ডিত হাত দুইখানি পরিপূর্ণ বিরামে বিছানার উপরে পড়িয়া আছে ; কুসুম-সুকুমার দুইটি পদতল তাহার সমস্ত রমণীয় গতি-চেষ্টাকে উৎসব-অবসানের সঙ্গীতের মত স্তব্ধ করিয়া বিছানার উপর মেলিয়া রাথিয়াছে—বিশ্রন্ধ বিশ্রামের এই ছবিখানি বিনয়ের কল্পনাকে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল ; শুক্তির মধ্যে মুক্তাটুকু যেমন, গ্ৰহতারামণ্ডিত নি:শব্দতিমিরবেষ্টিত এই আকাশমণ্ডলের মাঝখানটিতে ললিতার এই নিদ্রাটুকু, এই স্থডোল সুন্দর সম্পূর্ণ বিশ্রামটুকু জগতে তেমনি একটিমাত্র ঐশ্বৰ্য্য বলিয়া আজ বিনয়ের কাছে প্রতিভাত হইল। “আমি জাগিয়া আছি” “আমি জাগিয়া আছি” এই বাক্য বিনয়ের বিস্ফারিত বক্ষঃকুহর হইতে অভয় শঙ্খধ্বনির মত উঠিয়া মহাকাশের অনিমেষ জাগ্রত পুরুষের নিঃশব্দ বাণীর সহিত মিলিত হইল। এই কৃষ্ণপক্ষের রাত্রিতে আরো একটা কথা কেবলি বিনয়কে আঘাত করিতেছিল—আজ রাত্রে গোরা জেলখানায় । আজ পর্য্যস্ত বিনয় গোরার সকল সুখ দুঃখেই ভাগ লইয়া আসিয়াছে, এইবার প্রথম তাহার অন্যথা ঘটিল। বিনয় জানিত গোরার মত মানুষের পক্ষে জেলের শাসন কিছুই নহে কিন্তু প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত এই ব্যাপারে বিনয়ের সঙ্গে গোরার কোনো যোগ ছিল না—গোরার জীবনের এই একটা প্রধান ঘটনা একেবারেই বিনয়ের সংস্রব ছাড়া দুই বন্ধুর জীবনের ধারা এই যে এক জায়গায় বিচ্ছিন্ন হইয়াছে—আবার যখন মিলিবে তখন কি এই বিচ্ছেদের শূন্যতা পূরণ হইতে পরিবে ? বন্ধুত্বের সম্পূর্ণতা কি এবার ভঙ্গ হয় নাই ? জীবনের এমন অথও এমন দুর্লভ বন্ধুত্ব । আজ একই রাত্রে বিনয় তাহার এক অনুভব করিয়া জীবনের স্বজন-প্রলয়ের সন্ধিকালে স্তৱ হইয়া অন্ধকারের দিকে তাকাইয়া রহিল। গোরা যে ভ্রমণে বাহির হইয়াছিল দৈবক্রমেই নি। তাহাতে যোগ দিতে পারে নাই, অথবা গোরা যে জেলে গিয়াছে দৈবক্রমেই সেই কারাদুঃখের ভাগ লওয়া বিনয়ের পক্ষে অসম্ভব হইয়াছে, একথা যদি সত্য হইত তবে ইহাতে । করিয়া বন্ধুত্ব ক্ষুণ্ণ হইতে পারিত না। কিন্তু গোরা ভ্রমণে বাহির হইয়াছিল এবং বিনয় অভিনয় করিতেছিল ইং | আকস্মিক ব্যাপার নহে। বিনয়ের সমস্ত জীবনের ধারা এমন একটা পথে আসিয়া পড়িয়াছে যাহা তাহাদের পূর্ণ বন্ধুত্বের পথ নহে, সেই কারণেই এতদিন পরে এই বান্থ বিচ্ছেদও সম্ভবপর হইয়াছে। কিন্তু আজ আর কোনে উপায় নাই—সত্যকে অস্বীকার করা আর চলে না; গোরার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন একপথ অনন্তমনে আশ্রয় কর বিনয়ের পক্ষে আজ আর সত্য নহে। কিন্তু গোরাও বিনয়ের চিরজীবনের ভালবাসা কি এই পথভেদের দ্বারাষ্ট্র ভিন্ন হইবে ? এই সংশয় বিনয়ের হৃদয়ে হৃৎকম্প উপস্থিত করিল। সে জানিত গোরা তাহার সমস্ত বন্ধুত্ব এবং সমন্ত কৰ্ত্তব্যকে এক লক্ষ্য পথে না টানিয়া চলিতে পারে না। প্রচও গোরা ! তাহার প্রবল ইচ্ছা ! জীবনের সকল সম্বন্ধের দ্বারা তাহার সেই এক ইচ্ছাকেই মহীয়সী করিয়া সে জন্ম যাত্রায় চলিবে বিধাতা গোরার প্রকৃতিতে সেই রাজমহিমা অপণ করিয়াছেন! - ঠিক গাড়ি পরেশ বাবুর দরজার কাছে আসি৷ দাড়াইল । নামিবার সময় ললিতার যে পা কঁাপিল এবং বাড়িতে প্রবেশ করিবার সময় সে যে জোর করিয়া নিজেকে একটু শক্ত করিয়া লইল তাহা বিনয় স্পষ্ট বুঝিতে পালি।। ললিতা ঝোকের মাথায় এবার যে কাজটা করিয়া ফেলিয়াছে তাহার অপরাধ যে কতখানি তাহার ওজন সে নিজে কিছুতেই আন্দাজ করিতে পারিতেছিল না। ললিত জানিত পরেশ বাবু তাহাকে এমন কোনো কথাই বলিবেন না যাহাকে ঠিক ভৎসনা বলা যাইতে পারে—কিন্তু সেই জন্যই পরেশ বাবুর চুপ করিয়া থাকাকেই সে সব মো ভয় করিত । দিকের শূন্তত હઃ আর একদিকের পূর্ণতাকে একসঙ্গে ; ললিতার এই সঙ্কোচের ভাব লক্ষ্য করিয়া বিনয়, এরূপ গলে তাহার কি কৰ্ত্তব্য ঠিকটি ভাবিয়া পাইল না। সে সঙ্গে থাকিলে ললিতার সঙ্কোচের কারণ অধিক হইবে কি না তাহাই পরীক্ষা করিবার জন্য সে একটু দ্বিধার স্বরে ললিতাকে কহিল “তবে এখন যাই।” ললিতা তাড়াতাড়ি কহিল—“ন, চলুন, বাবার কাছে চলুন।” ললিতার এই ব্যগ্র অনুরোধে বিনয় মনে মনে আনন্দিত ষ্টেয়া উঠিল। বাড়িতে পৌছিয়া দিবার পর হইতেই তাহার যে কৰ্ত্তব্য শেষ হইয়া যায় নাই—এই একটা আকস্মিক ব্যাপারে ললিতার সঙ্গে তাহার জীবনের যে একটা বিশেষ গ্রন্থি বন্ধন হইয়া গেছে—তাহাই মনে করিয়া বিনয় ললিতার পাশ্বে যেন একটু বিশেষ জোরের সঙ্গে *াড়াইল। তাহার প্রতি ললিতার এই নির্ভর-কল্পনা যেন একটি স্পর্শের মত তাহার সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ সঞ্চার করিতে লাগিল। তাহার মনে হইল ললিতা যেন তাহার ডান হাত চাপিয়া ধরিয়াছে। ললিতার সহিত এই সম্বন্ধে তাহার পুরুষের বক্ষ ভরিয়া উঠিল। সে মনে মনে ভাবিল পরেশ বাবু ললিতার এই অসামাজিক হঠকারিতায় রাগ করিবেন, ললিতাকে ভৎসনা করিবেন, তখন বিনয় যথাসম্ভব সমস্ত দায়িত্ব নিজের স্বন্ধে লইবে—ভৎসনার অংশ অসঙ্কোচে গ্রহণ করিবে, বৰ্ম্মের স্বরূপ হইয়া ললিতাকে সমস্ত আঘাত হইতে বাচাইতে চেষ্টা করিবে। কিন্তু ললিতার ঠিক মনের ভাবটা বিনয় বুঝিতে পারে নাই। সে যে ভৎসনার প্রতিরোধক স্বরূপেই বিনয়কে ছাড়িতে চাহিল না তাহা নহে। আসল কথা, ললিতা কিছুই চাপা দিয়া রাখিতে পারে না। সে যাহা করিয়াছে তাহার সমস্ত অংশই পরেশ বাবু চক্ষে দেখিবেন এবং বিচারে যে ফল হয় তাহার সমস্তটাই ললিতা গ্রহণ করিবে এইরূপ ७शंद्र उांद । আজ সকাল হইতেই ললিতা বিনয়ের উপর মনে মনে রাগ করিয়া আছে। রাগটা যে অসঙ্গত তাহা সে সম্পূর্ণ জানে-কিন্তু অসঙ্গত বলিয়াই রাগটা কমে না বরং বাড়ে। ষ্টীমারে যতক্ষণ ছিল ললিতার মনের ভাব অন্তরূপ ছিল। ছেলেবেলা হইতে সে কথনে রাগ করিয়৷ কখনাে জেদ করিয়া একটা না একটা অভাবনীয় কাণ্ড ঘটাইয় আসিয়াছে কিন্তু এবারকার ব্যাপারটি গুরুতর। এই নিষিদ্ধ ব্যাপারে বিনয়ও তাহার সঙ্গে জড়িত হইয়া পড়াতে সে একদিকে সঙ্কোচ এবং অন্যদিকে একটা নিগৃঢ় হর্ষ অনুভব করিতেছিল। এই হর্ষ যেন নিষেধের সংঘাত দ্বারাই বেশি করিয়া মথিত হইয়া উঠিতেছিল। একজন বাহিরের পুরুষকে সে আজ এমন করিয়া আশ্রয় করিয়াছে, তাহার এত কাছে আসিয়াছে, তাহাদের মাঝখানে আত্মীয়সমাজের কোনো আড়াল নাই, ইহাতে কতখানি কুষ্ঠার কারণ ছিল--কিন্তু বিনয়ের স্বাভাবিক ভদ্রতা এমনি সংযমের সহিত একটি আক্র রচনা করিয়া রাথিয়াছিল যে এই আশঙ্কাজনক অবস্থার মাঝখানে বিনয়ের সুকুমার শীলতার পরিচয় ললিতাকে ভারি একটা আনন্দ দান করিতেছিল। যে বিনয় তাহাদের বাড়িতে সকলের সঙ্গে সৰ্ব্বদা আমোদ কৌতুক করিত, যাহার কথার বিরাম ছিল না, বাড়ির ভৃত্যদের সঙ্গেও যাহার আত্মীয়তা অবারিত এ সে বিনয় নহে। সতর্কতার দোহাই দিয়া যেখানে সে অনায়াসেই ললিতার সঙ্গ বেশি করিয়া লইতে পারিত সেখানে বিনয় এমন দূরত্ব রক্ষা করিয়া চলিয়াছিল যে তাহাতেই ললিতা হৃদয়ের মধ্যে তাহাকে আরো নিকটে অনুভব করিতেছিল। রাত্রে ষ্টীমারের ক্যাবিনে নান চিন্তায় তাহার ভাল ঘুম হইতেছিল না -ছট্‌ফট্‌ করিতে করিতে এক সময় মনে হইল রাত্রি এতক্ষণে প্রভাত হইয়। আসিয়াছে। ধীরে ধীরে ক্যাবিনের দরজা খুলিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দেখিল, রাত্রিশেষের শিশিরাষ্ট্ৰ অন্ধকার তপনো নদীর উপরকার মুক্ত আকাশ এবং তীরের বনশ্রেণীকে জড়াইয়া রহিয়াছে—এইমাত্র একটি শত বাতাস উঠিয়া । নদীর জলে কলধ্বনি জাগাইয়া তুলিয়াছে এবং নীচের তলায় এঞ্জিনের থালাসীরা কাজ আরম্ভ করিবে এমনতর চাঞ্চল্যের আভাস পাওয়া যাইতেছে। ললিতা ক্যাবিনের বাহিরে প্রবেশ করিয়াই দেখিল অনতিদূরে বিনয়- একটা গরম কাপড় গায়ে দিয়া বেতের চৌকির উপরে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। দেখিয়াই ললিতার হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হইয়া উঠিল। সমস্ত রাত্রি বিনয় ঐখানেই বসিয়া পাহারা দিয়াছে ! এতই নিকটে, তবু এত দূরে। ডেক্ হইতে তখনি ললিতা কম্পিত