পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

〉>や উপযুক্ত সাজে সজ্জিত হইয়া কাৰালিখিত অভিনয় করিতে থাকিবে। এ ছাড়া মেয়েরাও ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি এবং গান প্রভৃতি করিবে। বরদাসুন্দরী বিনয়কে অনেক ভরসা দিয়াছিলেন যে তাহাকে তাহার কোনো প্রকারে তৈরি করিয়া লইবেন। তিনি নিজে ইংরেজি অতি সামান্তই শিথিয়াছিলেন। কিন্তু তাহার দলের দুই এক জন পণ্ডিতের প্রতি র্তাহার নির্ভর छ्लि । কিন্তু যখন আখড়া বসিল, বিনয় তাহার আবৃত্তির দ্বারা বরদাসুন্দরীর পণ্ডিতসমাজকে বিস্মিত করিয়া দিল । তাহাদের মণ্ডলীবহিভূত এই ব্যক্তিকে গড়িয়া লইবার মুখ হইতে বরদাসুন্দরী বঞ্চিত হইলেন : পূৰ্ব্বে যাহারা বিনয়কে বিশেষ কেহ বলিয়া খাতির করে নাই, তাহারা, বিনয় এমন ভাল ইংরেজি পড়ে বলিয়া তাহাকে মনে মনে শ্রদ্ধা না করিয়া থাকিতে পারিল না। এমন কি, হারান বাবুও তাহার কাগজে মাঝে মাঝে লিথিবীর জন্য তাহাকে অনুরোধ করিল। এবং সুধীর, তাহাদের ছাত্রসভায় মাঝে মাঝে ইংরেজি বস্তৃতা করিবার জন্য বিনয়কে পীড়াপীড়ি করিতে আরম্ভ করিল। ললিতার অবস্থাটা ভারি অদ্ভুত রকম হইল। বিনয়কে যে কোনো সাহায্য কাহাকেও করিতে হইল না, সে জন্য সে খুসিও হইল, আবার তাহাতে তাহার মনের মধ্যে একটা অসন্তোষও জন্মিল। বিনয় যে তাহদের কাহারো অপেক্ষা নূ্যন নহে, বরঞ্চ তাহদের সকলের চেয়ে ভাল-সে যে মনে মনে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করিবে এবং তাহীদের নিকট হইতে কোনো প্রকার শিক্ষার প্রত্যাশা করিবে না ইহাতে তাহাকে আঘাত করিতে লাগিল। বিনয়ের সম্বন্ধে সে যে কি চায়, কেমনট হইলে তাহার মন বেশ সহজ অবস্থ৷ প্রাপ্ত হয় তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারিল না। মাঝে হইতে তাহার অপ্রসন্নতা কেবলি ছোটখাটো বিষয়ে তীব্র ভাবে প্রকাশ পাইয়া ঘুরিয়া ফিরিয়া বিনয়কেই লক্ষ্য করিতে লাগিল। বিনয়ের প্রতি ইহা যে সুবিচার নহে এবং শিষ্টতাও নহে তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারিল ; বুঝিয়। সে কষ্ট পাইল এবং নিজেকে দমন করিতে যথেষ্ট চেষ্ট৷ করিল কিন্তু অকস্মাৎ অতি সামান্ত উপলক্ষ্যেই কেন যে প্রবাসী। ব্যাপারের মৃক তিনি জানিতেন যে তাছার দ্বারা [ ৮ম ভাগ। তাহার একটা অসঙ্গত অস্তঞ্জলি সংযমের শাসন লঙ্গন ; করিয়া বাহির হইয় পড়িত তাহা সে বুঝিতে পারিত না। পূৰ্ব্বে যে ব্যাপারে যোগ দিবার জন্য সে বিনয়কে অবিশ্রাম উত্তেজিত করিয়াছে এখন তাহা হইতে নিরস্ত করিবার জন্যই তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল। কিন্তু এখন সমস্ত আরো জনকে বিপর্যাস্ত করিয়া দিয়া বিনয় অকারণে পলাতক হইবে কি বলিয়া ? সময়ও আর অধিক নাই ; এবং নিজের একটা নুতন নৈপুণ্য আবিষ্কার করিয়া সে নিজেই এই কাজে উৎসাহিত হইয়া উঠিয়াছে। অবশেষে ললিতা বরদাসুন্দরীকে কহিল, "আমি এন্তে । থাকব না।” বরদাসুন্দরী তাহার মেঝ মেয়েকে বেশ চিনিতেন, তাই নিতান্ত শঙ্কিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, "কেন ?" ললিত কহিল “আমি যে পারিনে ৷” বস্তুত যখন হইতে বিনয়কে আর আনাড়ি বলিয়া গণা করিবার উপায় ছিল না, তখন হইতেই ললিতা বিনয়ের সম্মুখে কোনো মতেই আবৃত্তি বা অভিনয় অভ্যাস করিতে চাহিত না—সে বলিত, আমি আপনি আলাদা অভ্যাস করিব। ইহাতে সকলেরই অভ্যাসে বাধা পড়িত কিন্তু ললিতাকে কিছুতেই পারা গেল না। অবশেষে, হার মানিয়া অভ্যাসক্ষেত্রে ললিতাকে বাদ দিয়াই কাজ চালাইতে হইল । কিন্তু যখন শেষ অবস্থায় ললিতা একেবারেই ভঙ্গ দিতে চাহিল, তখন বরদাসুন্দরীর মাথায় বজাঘাত হইল। ইহার প্রতিকার হইতেই পারবে না। তখন তিনি পরেশ বাবুর শরণাপন্ন হইলেন। পরেশ বাবু সামান্ত বিষয়ে কখনোই তাহার মেয়েদের ইচ্ছা অনিচ্ছায় হস্তক্ষেপ করিতেন না। কিন্তু ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে তাহারা প্রতিশ্রত হইয়াছেন, সেই অনুসারে সে পক্ষেও আয়োজন করিয়াছেন, সময়ও অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ, এই সমস্ত বিবেচনা করিয়া পরেশ বাবু ললিতাকে । ডাকিয় তাহার মাথায় হাত দিয়া কহিলেন, “ললিতা, এখন তুমি ছেড়ে দিলে যে অন্তায় হবে ।” ললিত রুদ্ধরোদন কণ্ঠে কহিল, “বাবা, আমি যে পারিনে। আমার হয় না।” ত সম্পন্ন করতেই হবে। ৩য় সংখ্যা । ] পরেশ কহিলেন, “তুমি ভাল না পারিলে তোমার | অপরাধ হবে না কিন্তু না করলে অষ্ঠায় হলে ।” ললিতা মুখ নীচু করিয়া দাড়াইয়া রহিল ;–পরেশ বাৰু কহিলেন, “মা, যখন তুমি ভার নিয়েছ তখন তোমাকে - পাছে অহংকারে ঘা লাগে বলে আর তা পালাবার সময় নেই। লাগুক্ না ঘা, সেটাকে অগ্রাহ করেও তোমাকে কৰ্ত্তব্য করতে হবে। পারবে না | ?" ললিতা পিতার মুখের দিকে মুথ তুলিয়া কহিল “পারব।” সেই দিনই সন্ধ্যাবেলায় বিশেষ করিয়া বিনয়ের সম্মুখেই সমস্ত সঙ্কোচ সম্পূর্ণ দূর করিয়া সে যেন একটা অতিরিক্ত স্বলের সঙ্গে যেন পদ্ধা করিয়া নিজের কৰ্ত্তব্যে প্রবৃত্ত হইল। বিনয় এত দিন তাহার আবৃত্তি শোনে নাই। আজ শুনিয়া আশ্চৰ্য্য হইল। এমন সুস্পষ্ট সতেজ উচ্চারণ –কোথাও কিছুমাত্র জড়িমা নাই, এবং ভাব প্রকাশের মধ্যে এমন একটা নিঃসংশয় বল, যে, শুনিয়া বিনয় প্রত্যাশাতীত আনন্দ লাভ করিল। এই কণ্ঠস্বর তাহার কাণে অনেকক্ষণ ধরিয়া বাজিতে লাগিল । কবিতা আবৃত্তিতে ভাল আবৃত্তিকারকের সম্বন্ধে শ্রোতার মনে একটা বিশেষ মোহ উৎপন্ন করে। সেই কবিতার ভাবটি তাহার পাঠককে মহিমা দান করে—সেটা যেন তাহার কণ্ঠস্বর, তাহার মুখশ্ৰী, তাহার চরিত্রের সঙ্গে জড়িত হইয়া দেখা দেয়।. ফুল যেমন গাছের শাখায় তেমনি কবিতাটিও আবৃত্তিকারকের মধ্যেই ফুটিয়া উঠিয় তাহাকে বিশেষ সম্পদ দান করে। ললিতাও বিনয়ের কাছে কবিতায় মণ্ডিত হইয়া উঠিতে লাগিল। ললিতা এতদিন তাহার তীব্রতার দ্বারা বিনয়কে অনবরত উত্তেজিত করিয়া রাথিয়াছিল। যেখানে ব্যথা সেইখানেই কেবলি যেমন হাত পড়ে,বিনয়ও তেমনি কয়দিন ললিতার উষ্ণ বাক্য এবং তীক্ষ হাস্ত ছাড়া আর কিছু ভাবিতেই পারে নাই । কেন যে ললিতা এমন করিল, তেমন বলিল, ইহাই তাহাকে বারম্বার আলোচনা করিতে হইয়াছে –ললিতার অসন্তোষের রহস্ত যতই সে ভেদ করিতে না পারিয়াছে ততই ললিতার চিন্তা তাহার মনকে অধিকার করিয়াছে। হঠাৎ ভোরের বেলা ঘুম হইতে গোরা । 〉>6 জাগিয়া সে কথা তাহার মনে পড়িয়াছে ; পরেশ বাবুর বাড়িতে আসিবার সময় প্রত্যহই তাহার মনে বিতর্ক উপস্থিত হইয়াছে আজ না জানি ললিতাকে কিরূপ ভাবে দেখা যাইবে । যে দিন ললিতা লেশমাত্র প্রসন্নতা প্রকাশ করিয়াছে সেদিন বিনয় যেন ইপি ছাড়িয়া বাচিয়াছে এবং এই ভাবটি কি করিলে স্থায়ী হয় সেই চিন্তাই করিয়াছে কিন্তু এমন কোনো উপায় খুজিয়া পায় নাই যাহা তাহার আয়ত্তাধীন। এ কয়দিনের এই মানসিক আলোড়নের পর ললিতার কাব্য আবৃত্তির মাধুর্য বিনয়কে বিশেষ করিয়া এবং প্রবল করিয়া বিচলিত করিল। তাহার এত ভাল লাগিল যে কি বলিয়া প্রশংসা করিবে ভাবিয়া পাইল না। ললিতার মুখের সাম্নে ভাল মন্দ কোনো কথাই বলিতে তাহার সাহস হয় না—কেন না তাহাকে ভাল বলিলেই, যে, সে খুসি হইবে মনুষ্যচরিত্রের এই সাধারণ নিয়ম ললিতার সম্বন্ধে না থাটিতে পারে,—এমন কি, সাধারণ নিয়ম বলিয়াই হয় ত থাটিবে না—এই কারণে, বিনয় উচ্ছসিত হৃদয় লইয় বরদাসুন্দরীর নিকট ললিতার ক্ষমতার অজস্র প্রশংসা করিল। ইহাতে বিনয়ের বিস্কা ও বুদ্ধির প্রতি বরদা: সুন্দরীর শ্রদ্ধা আরও দৃঢ় হইল। আর একটি আশ্চৰ্য্য ব্যাপার দেখা গেল। ললিতা যখনি নিজে অনুভব করিল তাহার আবৃত্তি ও অভিনয় অনিন্দনীয় হইয়াছে ; মুগঠিত নৌকা ঢেউয়ের উপর দিয়া যেমন করিয়া চলিয়া যায় সেও যথন তেমনি স্বন্দর করিয়া তাহার কৰ্ত্তব্যের দুরূহতার উপর দিয়া চলিয়া গেল তখন হইতে বিনয়ের সম্বন্ধে তাহার তীব্রতাও দূর হইল। বিনয়কে বিমুখ করিবার জন্য তাহার চেষ্টামাত্র রহিল না। এই কাজটাতে তাহার উৎসাহ বাড়িয়া উঠিল এবং ৱিহার্সাল ব্যাপারে বিনয়ের সঙ্গে তাহার যোগ ঘনিষ্ঠ হইল। এমন কি, আবৃত্তি অথবা অন্য কিছু সম্বন্ধে বিনয়ের কাছে উপদেশ লইতে তাহার কিছুমাত্র আপত্তি রছিল না। ললিতার এই পরিবর্তনে বিনয়ের বুকের উপর হইতে যেন একটা পাথরের বোঝা নামিয়া গেল। এত আনন্দ হইল যে যখন তখন আনন্দময়ীর কাছে গিয়া বালকের মত ছেলেমানুষি করিতে লাগিল। স্বচরিতার কাছে বসিয়৷