পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨૭ যেন দুঃসহ বেদনায় টন টন করিতেছে ! পাশের ঘরে প্রতিদিনকার কলরব তেমনি উদাম । পরেশ হয়ত নিত্যকার অভ্যাসমত দুঃখ ভুলিতে বাহির হইয়াছে। অবহেলিত রোগজর্জরিত সে পড়িয়া আছে সুস্থ জগতের বাহিরে, এই ক্ষুদ্র কক্ষই যেন তার সত্যকার বিশ্রামস্থল । কে একজন কক্ষদ্বারে উকি মারিলেন এবং মোট গলায় বলিলেন, “কেমন আছ কমলবাবু ?” কমল কি বলিতে গেল—স্বর বাহির হইল না । লোকটি চৌকাঠের উপর এক পা রাখিয়া সন্তপণে একটু ঝুকিয়া বলিলেন, “মুখে যেন সব কি বেরিয়েছে ? সব গায়ে কি খুব ব্যথা ?” কমল ঘাড় নাড়িয়া জানাইল,—“হঁ৷ ” লোকটি দুই চক্ষু কপালে তুলিয়া বলিল, “তবেই হয়েছে ! মার অনুগ্রহ ! আমি তখনই বলেছিলাম—” বলিয়া আর ক্ষণমাত্র সেখানে না দাড়াইয়। অপরকক্ষে ক্রীড়ারত লোকগুলিকে উদ্দেশ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন–“অ মশাই কালীবাবু, শুনছেন কুমুদবাবু, ওহে ক্ষেত্তর—আর ত এ মেসে থাকা চলে না । কমলবাবুর মার অনুগ্রহ হয়েছে - একেবারে স্মল পক্স । কই ম্যানেজার শঙ্করবাবু গেলেন কোথায় ? তিনি এর যাহয় একটা বিহিত করুন ।” কাহারও মুখে বাক্যক্ষুক্তি হইল না, শঙ্কিত অস্তরে সকলেই বক্তার মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন । ফটাস ফটাস চটি জুতার শব্দ করিতে করিতে শঙ্করবাবু ছাদ হইতে নামিয়া আসিলেন । কহিলেন, “ভূষণবাবু, এত চীৎকার করছেন কেন ? হ’ল কি ?” ভূযণবাবু মুখভঙ্গী করিয়া কহিলেন, “হয়েছে আমার মাথা আর মুণ্ডু । দেখুন গে, ওই ঘরে গিয়ে কমলের অবস্থা ?” শঙ্করবাবু কমলের কক্ষের সম্মুখে আসিয়৷ ডাকিলেন, “কমলবাবু, কমলবাবু ?” আচ্ছন্নের মত কমল উত্তর দিল, “আঁ৷ ” শঙ্করবাবু বলিলেন, “শুনছেন,—আপনার পক্স হয়েছে প্রবাসা—কাৰ্ত্তিক, ১৩৩৭ [ ৩০শ ভাগ, ২য় খণ্ড দেখে মেসের সবাই ভয় খেয়ে গেছেন। প্লাল সকালেই এখান থেকে বাড়ী চলে যাবেন, বুঝলেন ? আর এখন সেখানে যাওয়াই আপনার উচিত । সেখানে মা আছেন, বোন আছেন, তারা দেখতে শুনতে পারবেন। আপনার পক্ষেই ভাল ”—বলিয়৷ উত্তরের অপেক্ষ না করিয়া দ্রুতপদে ছাদের উপর চলিয়া গেলেন । অনেক রাত্রিতে পরেশ মেসে ফিরিল। পাশ্বের কক্ষে সকলেই তখন নিদ্রিত, শুধু কমল শয্যায় শুইয়া—‘জল’ ‘জল’ বলিয়৷ চীৎকার করিতেছে । ঘরে ঢুকিয় আলো জালিয়া কমলের অবস্থা দেখিয়৷ পরেশের নেশ কাটিয়া গেল। তাড়াতাড়ি কলসী হইতে এক গ্লাস জল ঢালিয়া রোগীর শিয়রে বসিয়া স্নেহভরা কণ্ঠে ডাকিল, “কমলবাবু ?” রক্ততাথি মেলিয়৷ কমল হা করিল ও একনিঃশ্বাসে অনেকখানি জল পান করিয়া ক্ষুদ্র একটি 'আঃ' বলিয়৷ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিল । পরেশ তাহার মাথার মধ্যে অঙ্গুলি চালনা করিতে করিতে বলিল, “জরটা কি খুব বেশী হয়েছে ? বড় যন্ত্রণ হচ্ছে ?” কমল ক্ষীণস্বরে বলিল, “হ্যা । কিন্তু তুমি এখানে থেক ন ভাই, বড় ছোয়াচে রোগ " পরেশ হাসিয়া বলিল, “সমুদ্রে যার শয্যা-শিশিরে তার কি ভয় ! এ লক্ষ্মীছাড়ার জীবন গেলেই বা কি, আর থাকলেই বা কি ? কমল, সংসারে যে স্নেহবঞ্চিত তার জীবনের আসক্তি খুব কমই জেনে ৷” কমল তাহার হাত দুখানি চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “তুমি জান ন ভাই, এই স্নেহই মানুষের অভেদ্য বৰ্ম্ম । এরই আচ্ছাদনে শোক দুঃখ অগ্রাহ ক’রে সে মহান জীবন-পথের বৃহত্তর লক্ষ্যে পৌঁছাবার আশা করে । ভাই পরেশ, আমায় একবার বাড়ী নিয়ে যেতে পার ? আমার মার কাছে, ভাই বোনেদের কাছে ?” পরেশ বলিল, “দেখি চেষ্টা ক’রে ।” পরেশের হাত চাপিয়া ধরিয়া ক্ষীণ আগ্রহোত্তেজিতকণ্ঠে কমল বলিল, “ন!—না ভাই, আমায় বাড়ী নিয়ে চল—নিয়ে চল । মার কোলে গিয়ে যেন শেষ নিঃশ্বাস