পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৭৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অপরাজিত ঐবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ( ১৭ ) ছুটি ফুরাইলে অপু বাড়ী হইতে রওনা হইল । ষ্টেশনে আসিয়া কিন্তু ট্রেন পাইল না, গহনার নৌক৷ আসিতে অত্যন্ত দেরী হইয়াছে, ট্রেন আধঘণ্টা পূৰ্ব্বে ছাড়িয়া দিয়াছে। সৰ্ব্বজয় ছেলের বাড়ী হইতে যাইবার দিনটাতে অন্যমনস্ক থাকিবার জন্য কাপড়, বালিশের ওয়াড় সাজিমাটি দিয়া সিদ্ধ করিয়া বাশবনের ডোবার জলে কাচিতে নামিয়াছে’- সন্ধ্যার কিছু পূৰ্ব্বে অপু বাড়ীর দাওয়ায় জিনিষপত্র নামাইয় ছুটিয়া ডোবার ধারে গিয়া পিছন হইতে ডাকিল—ওমা ! •• সৰ্ব্বজয়া ভুলিয়া থাকিবার জন্য দুপুর হইতেই কাপড় সিদ্ধ লইয়া ব্যস্ত আছে। চমকিয়া পিছন দিকে চাহিয়৷ আনন্দ-মিশ্রিত স্বরে বলে—তুই .যাওয়া হ’ল না ?-- অপু হাসিমুখে বলে–গাড়ী পাওয়া গেল না—এস বাড়ী— বাশবনের ছায়ায় মায়ের মুখে সেদিন যে অপূৰ্ব্ব আনন্দের ও তৃপ্তির ছাপ পড়িয়াছিল, অপু পূৰ্ব্বে কোনে দিন তাহা দেখে নাই—বহুকাল পর্য্যন্ত মায়ের এ মুখখান তার মনে ছিল । সেদিন রাত্রে দুজনে নানা কথা । অপু ছেলেবেলাকার গল্প শুনিতে চায় মার মুখে—নিশ্চিন্দিপুর সেখানকার সে-সব অপূৰ্ব্ব জ্যোৎস্না রাত্রি, অপূৰ্ব্ব সে-সব সন্ধ্যার মায়া গল্পগুলির সঙ্গে মাথানে । শুনিতে শুনিতে মন তাহার অসীম তৃপ্তি ও স্নিগ্ধতায় ভরিয় ওঠে । পরদিন সে কলিকাতায় ফিরিল। কলেজ সেইদিনই প্রথম খুলিয়াছে, প্রমোশন পাওয়৷ ছেলেদের তালিকা বাহির হইয়াছে, নোটীশ বোর্ডের কাছে রথযাত্রার ভিড়—সে অধীর আগ্রহে ভিড় ঠেলিয়া নিজের নামটা আছে কিনা দেখিতে গেল । আছে! দু তিনবার বেশ ভাল করিয়া পড়িয় দেখিল । আরও আশ্চৰ্য্য এই যে, পাশেই যেসব ছেলে পাশ করিয়াছে অথচ বেতন বাকী থাকার দরুণ প্রমোশন পায় নাই, তাহদের একটা তালিকা দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু তাহার মধ্যে অপুর নাম নাই, অথচ অপু জানে তারই সৰ্ব্বাপেক্ষ বেশী বেতন বাকী ! সে ব্যাপারটা বুঝিতে না পারিয়া ভিড়ের বাহিরে আসিল। কেমন করিয়া এরূপ অসম্ভব সম্ভব হইল, নানাদিক হইতে বুঝিবার চেষ্টা করিয়াও তখন কিছু ঠাহর করিতে পারিল না । দু তিন দিন পরে তাহার এক সহপাঠী নিজের প্রমোশন বন্ধ হওঁয়ার কারণ জানিতে আপিস্-ঘরে কেরানীর কাছে গেল, সে-ও গেল সঙ্গে । হেডক্লার্ক বলিল -একি ছেলের হাতের মোয় হে ছোকরা ! কত রোল ? ••••• পরে একখানা বাধানে খাত খুলিয়া আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল—এই দ্যাখে। রোল টেন লাল কালির মার্কা মারা রয়েছে—ছ মাসের মাইনে বাকী—মাইনে শোধ না দিলে প্রমোশন দেওয়৷ হবে না, প্রিন্সিপালের কাছে যাও, আমি আর কি করবো ? অপু তাড়াতাড়ি ঝুকিয়া পড়িয়া দেখিতে গেল— তাহার রোল নম্বর কুড়ি—একই পাতায় । দেখিল অনেক ছেলের নামের সঙ্গে লালকালিতে ‘ডি’ লেখা আছে অর্থাৎ ডিফণ্টাৰ্ব-মাহিনা দেয় নাই। সঙ্গে সঙ্গে নামের উন্ট দিকে মন্তব্যের ঘরে কোন মাসের মাহিন বাকী তাহ লেখা আছে। কিন্তু তাহার নামটাতে কোনো কিছু দাগ বা আঁচড় নাই—একেবারে পরিষ্কার মুক্তার মত হাতের লেখা জলজল করিতেছে—রায় অপূৰ্ব্ব কুমার-লাল কালির একটা বিন্দু পৰ্য্যন্ত নাই!. ঘটনা হয়ত খুব সামান্ত, কিছুই না—হয়ত এটা সম্পূর্ণ কলমের ভুল, ন হয় কেরানীর হিসাবের ভুল, কিন্তু অপুর মনে ঘটনাটা গভীর রেখাপাত করিল।