পাতা:প্রবাসী (দশম ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

> >br রসিক বলিল—“বুড়ে-কৰ্ত্তার আমলে তার চেয়ে তা বেশী রোজগার কর্তে ।” “আহ৷ আমি কি শুধু মাইনের উপরই নির্ভর করব? মাইনেটা ত হ’ল আমার উপরি পাওনা। তার পর উকীলের ফি থেকে যে কমিশনটা পেতাম—সে সব দ্যায্য পাওনাগুলো আমার যাচ্ছে কোথায়? পূৰ্ব্বে উকীলের কাছ থেকে শতকরা পচিশ টাকা হিসাবে কমিশন পেয়ে এসেছি। এদানী শুনছি উকীলের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে- উকীলদের মধ্যে বিরিফের জন্তে এমনি থেয়োথেয়ি পড়ে গেছে—যে এখন যদি ফি দিয়ে আধাআধি বখরাও চাই, তাও তারা সোনাহেন মুখ করে দেবে।" o সাত দিন পরে বাবু আসিতে বলিয়াছিলেন, এ সাত দিন গদাই পালের আর কাটে না। সকলের কাছে বলিয়া বেড়াইতে লাগিল যে বাবু মহাশয় তাহাকে মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে মামলা মোকৰ্দমার তদ্ধিরকারক নিযুক্ত করিয়াছেন। এখন পঞ্জিকার দিন ভাল নাই বলিয়া বাৰু , প্রবাসী—জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭। ....-------------------.....................................--------------------------------۰۰۰...................... [ ১০ম ভাগ । রবিবারে আনিয়া দিত। এইরূপে প্রত্যেক উকীলের নিকট হইতে কিছু কিছু সংগ্ৰহ করিয়া জুতা, জাম, ধুতি, ছাতা প্রভৃতি কিনিয়া গ্রামে ফিরিয়া আসিল । সপ্তাহ পূর্ণ হইল। চাকরী হইলে গ্রামস্থ সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে যোড়া পাট বলি দিবে মানত করিয়া গদাধর জমিদার বাবুর গৃহে উপনীত হইল। পূৰ্ব্ববর্ণিত কক্ষে যতীন্দ্রবাবু চেয়ারে বসিয়া ছিলেন। সে গিয়া প্রণাম করিয়া বিনীত ভাবে মেঝের উপর বিছানো ফরাসে উপবেশন করিল। দুই একটা অন্য কথার পর, যতীন্দ্র বাবু একটি বাণ্ডিল খুলিয়া সেই তমলুকখানি বাহির করিয়া বলিতে লাগিলেন— “বা:–তোমার বাহাদুরী আছে! সেরেস্তা থেকে পুরান চেকমুড়ি আনিয়ে, তার পিঠে রমণ ঘোষের অনেকগুলো দস্তখতের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলাম, তমলুকের এ সই একেবারে অবিকল মিলে যাচ্চে ।” গদাই আহলাদে গদগদ হইয়া বলিল—“আজ্ঞে, চেক মহাশয়ের হাতে পায়ে ধরিয়া কোনমতে এক সপ্তাহের * মুড়ির পিঠে দস্তখং দেখেই ত’ তমলুকেরও সই জাল অবকাশ লইয়াছে। সাত দিন পরে তাহাকে চাকরী আরম্ভ করিতেই হইবে। সে যাহার কাছে টাকা কৰ্জ চাহিল, সেই ভয়ে ভয়ে তাহাকে কৰ্জ্জ দিল। এই প্রকারে পঞ্চাশ ষাট টাকা সে সংগ্ৰহ করিল। এদিকে, তাহার ভবিষ্যৎ ক্ষমতা ও উন্নতির সম্ভাবনা জানিয়া, রসিকমোহনের বাড়ীতেও তাহার জলখাবার ও দুগ্ধের বরাদ্দ বাড়িয়া গেল । ইতিমধ্যে একদিন সদরে গিয়া উকীলগণের সহিতও গদাই সাক্ষাৎ করিল। নিজের অসামান্ত পদবীলাভ বর্ণনা করিয়া বলিল,যে, শীঘ্রই কয়েকটা বড় বড় সত্ত্বসাবাস্তের মোকৰ্দমা দায়ের হইবে। প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা করিল, আজ্জির মুসবিদ করাইবার জন্য আগামী রবিবারে আসিলে উকীল মহাশয়ের অবকাশ হইবে কি ? উঠিবার সময় কোনও উকীলকে বলিল, যোড়াহুই কাপড় কিনিবার প্রয়োজন ছিল, কাহাকেও বলিল একযোড়া জুতা কিনিতে হইবে, কাহাকেও বলিল গোটাভুই জামা নিতান্ত আবশ্যক, কাহাকেও বলিল একটা ছাতা না কিনিলেই নয়—কিন্তু বাড়ী হইতে আসিবার সময় তাড়াতাড়িতে টাকা আনিতে ভুলিয়া গিয়াছে, গোটাকতক টাকা হাওলাং পাইলে করেছিলাম।” যতীন্দ্রবাবু বলিলেন—“যে সময় জাল করেছিলে, সে সময়ের পাচ বছর আগে এ ষ্ট্যাম্পকাগজখানি বিক্রী হয়েছিল—ভেণ্ডারের সই তারিখ রয়েছে। এত পুরান কাগজ পেলে কোথা ?” “আজ্ঞে ফিবছর বাণ্ডিল বাণ্ডিল নানা মূল্যের ইষ্টাম্প কাগজ কিনে বাড়ীতে তুলে রেখে দিতাম। কোন সময়ে কত বছরের পুরান কাগজ দরকার হয় তা কি বলা যায় ?” “বটে —আর কালি ?—নূতন কালিতে লিখেছিলে ত? আদালতের সন্দেহ হল না ?” মৃদুহান্ত করিয়া গদাই বলিল—“আজ্ঞে তার উপায় আছে। কাগজ থানা লিখে, দিনকতক আছাট চাউলের মধ্যে গুজে রাখতে হয়। কুঁড়ো লেগে কালির রং কাগজের রং দুই বদলে যায়।” যতীন্দ্র বাবু একটু মৃদুহান্ত করিয়া অনুচ্চস্বরে ডাকিলেন —“রমণ ।” - পাশ্বের কক্ষ হইতে, ঝন্‌ করিয়া পর্দা সরাইয়া দিয়া, রমণচন্দ্র ঘোষ প্রবেশ করিল। ২য় সংখ্যা । ] যতীন বাবু বলিলেন—“কেমন হে গদাধর—এই সেই রমণ ঘোষ নয় ?” গদাই পালের মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। তাহার চক্ষু কপালে উঠিল, নিশ্বাস ঘন ঘন পড়িতে লাগিল। সৰ্ব্বশরীর ঘামে ভিজিয়া উঠিল । তাহার মনে হইল, একটা অনির্দিষ্ট বিপদ যেন তাছাকে গ্রাস করিতে আসিতেছে । “কেমন, এই সেই রমণ ঘোষ—যার নামে জাল করে সৰ্ব্বস্ব নীলাম করিয়ে নিয়েছিলে ?” গদাই হতবুদ্ধি হইয়া, কষ্টে বলিল—“আজ্ঞা হ্যা।” যতীনবাবু বলিলেন—"রমণ, আমাদের দ্বারা তোমার উপর যা অত্যাচার হয়েছে—তার জন্তে আমি বড় দুঃখিত। তুমি যদি ইচ্ছা কর, আবার এসে আমার জমিদারীতে বাস কর । আমি তোমায় খুব সুবিধা দরে জমি দেববাড়ী নিজে থেকে তৈরি করে দেব।” রমণ একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিল—“আজ্ঞে, হুজুরের বড় দয়া, হুজুর গরীবের মা বাপ। আমার বয়স যদি আরও দশ বছর কম হত, এথনি উঠে এসে এ রামরাজ্যে বসতি করতাম। কিন্তু বুড়ো হয়েছি। সেখানে মামাদের কিছু বিষয় পেয়েছিলাম, তাই বাড়িয়ে গুছিয়ে, ছেলে পিলে নাতি পুতি গোরু বাছুর নিয়ে একরকম আছি। এ বয়সে উঠে আসা বড় কষ্টকর হবে।”— বলিয়া রমণ ঘোষ করপুটে দাড়াইয়া রহিল। * যতীনবাবু বলিলেন—“কোথায় এখন আছ ?” “আজ্ঞা, খুলনা জেলায় সাজিয়াড় গ্রামে।” “জমিদার কে ?” “কল্যাণপুরের বাড় যে মশায়ের। তারা कुश् उड़ेिंবড় গোপীকান্ত বাবুই জমিদারী দেখেন।" “তা বেশ । যদি তোমার সুবিধা হয়, সেইখানেই থাক। আমাদের দ্বারা তোমার যা অনিষ্ট হয়েছে, তার কিঞ্চিং ক্ষতিপূরণ স্বরূপ আমি তোমায় ৫০০ দিচ্ছি। খাজাঞ্চীর নামে এই হুকুমনাম লিখে দিলাম, কাছারি থেকে টাকা নিয়ে যেও।” আনন্দে রমণ ঘোষ যতীন্দ্রবাবুর পদধূলি লইল । যতীন্দ্র তখন গদাই পালের প্রতি ফিরিয়া বলিলেন"এ জীবনে ভূমি অনেক ছদ্ধৰ্ম্ম করেছ। এখনি তোমায় নবীন সন্ন্যাসী । 〉>ふ পুলিসের .হাতে দিতাম। কিন্তু সম্প্রতি তুমি ছ বছর জেল থেটে এসেছ, তাই আপাততঃ তোমায় মাপ করলাম। কিন্তু তোমার প্রতি এই হুকুম, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তুমি আমার এলাকা ছেড়ে চলে যাবে। যদি কখনও শুনতে পাই যে তুমি আমার এলাকার মাটি মাড়িয়েছ, তখনি রমণ ঘোষকে দিয়ে তোমার নামে জালের নালিস করিয়ে দেব। আমার কাছে তুমি যে স্বীকারোক্তি করেছ, আমি নিজে সে বিষয়ে সাক্ষী দেব।”—তাহার পর রমণের প্রতি ফিরিয়া বলিলেন—“কিহে—আমার চিঠি পেলে তুমি এসে নালিস্ দায়ের করবে ত?” রমণ বলিল—“আজ্ঞা হ্যা যদি বেঁচে থাকি ত হুজুরের হুকুম পাওয়া মাত্র তামিল করব।” “আচ্ছ বেশ, এখন তোমরা দুজনেই যেতে পার।" গদাই পাল গৃহে ফিরিয়া আসিয়া বলিল—“বাবুদের যেমন কাও ! এক হস্তা আমায় বসিয়ে রাখলেন,— আজ গেলাম–ছঘণ্টা ধরে অপেক্ষ করলাম—তবু বাবুর সাক্ষাৎ পাওয়া গেল না ।” অtহারাদি করিয়া গদাই শয়ন করিল। কিন্তু নিদ্র গেল না। রাত্রি গভীর হইলে, সকলে যখন নিদ্রিত হইয়াছে, আস্তে আস্তে উঠিয়া, নিজের অল্প যাহা জিনিষপত্র ছিল, পুটুলি বাধিয়া লইয়া, পদব্রজে গ্রাম ত্যাগ করিয়া গেল। তাহার মনে ধারণা জন্মিয়াছিল, পৃথিবীতে তাহার সবচেয়ে বড় শত্র রহিল রমণ ঘোষ - বাবু না বলিলেও, সে নিজে যেদিন ইচ্ছাজালের মোকৰ্দ্দমা দায়ের করিতে পারে। আর, বাবু যদি নালিস করেন, রমণ ঘোষই প্রধান সাক্ষী। রমণ যতক্ষণ আসিয়া না বলিবে এ তমলুকের দস্তথ২ আমার নহে—ততক্ষণ মোকৰ্দমা প্রমাণ হইবে না । সুতরাং শত্র দমন আবশুক—এবং সে অভিপ্রায় সিদ্ধ করিতে হইলে—রমণ ঘোষের যিনি জমিদার, কল্যাণপুরের গোপীকান্ত বাৰু, তাহার অধীনে চাকরী করাই প্রকৃষ্ট উপায়। গদাই পাল যে কল্যাণপুরে পৌছিয়া গোপীকান্ত বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছে, সে সংবাদ পাঠক পূৰ্ব্বেই পাইয়াছেন । ক্রমশঃ ঐ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়.