পাতা:প্রবাসী (দ্বাত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৭১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শৃঙ্খল ঐসুধীরকুমার চৌধুরী & ছোট একটি বাগানের পথে একসার রজনীগন্ধার পাশ কাটাইয়া দীপালোকিত একটি গাড়ী-বারান্দার নীচে আসিয়া ট্যাক্সি দাড়াইল । বিমান নামিয়া-পড়িয়া নিজের পকেট হইতে টাকা বাহির করিয়া ভাড়া চুকাইল, তারপর একমুহূৰ্ত্ত অজয়ের দিকে ফিরিয়া কেবলমাত্র "এস" বলিয়া অগ্রসর হইয়া গেল, তাহাকে প্রশ্ন করিবারও অবসর দিল না । অন্তদিন হইলে অজয় তাহাকে ডাকিয়া ফিরাইয়া তর্ক করিত, বলিত, বিনা নিমন্ত্রণে অথবা বিনা প্রয়োজনে কোনও অপরিচিত-গৃহে প্রবেশ করা তাহার রীতি নহে, কিন্তু আজ পরিচয়-অপরিচয়ের মধ্যেকার সীমারেখা সত্যই অনেকখানি ঝাপসা হইয়া গিয়াছে, তদুপরি জাজ বিমান ইচ্ছা করিবে এবং সে নীরবে মাগু করিবে, ইহা পূৰ্ব্ব-হুইতে স্থির করিয়াই তাহার সঙ্গে সে পথে বাহির হইয়াছিল, স্বতরাং নামিয়া-পড়িয়া বিনা বাক্যব্যয়েই তাহার অমুসরণ করিল। ভবানীপুরের এক বিরলবাস পল্লীতে তিনতলা মৃদঙ্গ একটি বাড়ী । দ্বতলার প্রায় সমস্তটা জুড়িয়াই মাঝারিগোছের একটা হল। প্রথমদুষ্টিতে গৃহসজ্জা অজয়ের কিছুই প্রায় চোখে পড়িল না, তীব্র বিস্থাতের আলো সবকিছুতে যেন আগুন ধরাইতেছে। অগ্নিশিখারই মত চঞ্চল প্রদীপ্ত রূপজ্যোতির কয়েকটি শিখাকে সে অপরিস্ফট কিন্তু নিদারুণভাবে তাহার মস্তিষ্কের মধ্যে অনুভব করিল মাত্র । বিমান তাহাকে উপরে পৌছাইয়া দিয়াই কোথায় অন্তৰ্দ্ধান করিয়াছিল,সন্মুখে ষে শূন্ত আসন পাইল তাহাতেই বসিয়া-পড়িয়া অজয় ভাবিতে লাগিল,নীচে হইতে পলাইতে পারিলেই ছিল ভাল। কোনও দিকে ভাল করিয়া না তাকাইয়াই কেমন অকারণেই তাহার মনে হইতে লাগিল, অত্যন্ত আচিন্তিত উপায়ে আজ এইখানে তাহার প্রবাস প্রিয়ার সঙ্গে তাছার সাক্ষাৎ হুইয়া যাইবে । এই জ্যোতিঃপ্লাবিত উৎসবক্ষেত্রের অধিষ্ঠাত্রীরূপিণী সেই জ্যোতিৰ্ম্ময়ী অদূরেই কোথায় যেন রহিয়াছে, অজয়কে সে দেখিতেছে, কৌতুক অনুভব করিতেছে । হাসিলে তাহাকে কেমন দেখায় অজয় জানে না, অন্ত-সকলের মত আত্মবিস্তুত হইয়া সে হালিতেছে অজয় তাহা ভাবিতে পারে না, তবু অজয়ের মনে হইল হাসির আবেগে তাহার মুকুমার অধরপ্রান্ত কঁাপিতেছে। অপরিচিত নারীদের সান্নিধ্যে নিজেকে বিপন্ন বোধ করা অজয়ের চিরকালের স্বভাব, কিন্তু আজ সে যথারীতি অনুস্থ বোধ করিতে লাগিল। জোর করিয়া মনটাকে ফিরাইবার উচ্ছেপ্তে আগ্রহের অভ্যন্ত অভাব সত্বেও চতুৰ্দ্দিকটাকে সে দেখিয়া লইতে লাগিল । ঘরের মেঝেতে কাপেটের উপর ধবধবে শাদ চাদর পাতিয়া মন্ত ফরাস তৈয়ারী হুইয়াছে। ফরাসের উপর ইতস্ততবিক্ষিপ্ত কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র। একটি যুবক এক কোণে পা ছড়াইয়। বসিয়া কোলের উপর একটা সেতার টানিয়া তাহাতে স্বর বাধিবার চেষ্টা করিতেছে। অজয়ের মনে হইল, বারেবারেই ঠিক স্বরটিতে ঘা পড়িতেছে, কিন্তু অকারণেই যুবকের মন উঠিতেছে না। অনাৰশুক থানিকট নামাইয়া আবার সে স্বর কষিয়া বাধিতেছে, কখনও বা অনাবশ্যক অনেকখানি চড়া করিয়া বাধিয়া তারপর তারের টান আস্তে আস্তে আলগা করিতেছে। অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিয়া দেখিয়া বিরক্তিতে অজয়ের ঠোঁটের কাছটা শক্ত হইয়া উঠিল, এক ৰুটুকায় সেদিক্ হইতে সে চোখ-দুইটাকে ফিরাইয়া লইল । ফরাসের মাঝামাঝি জায়গায় আর-একটি যুবক কোলের কাছে একটা পাখোয়াজ লইয়া অত্যন্ত হতাশ মুখে বসিয়া আছে। একদিকে বেশ অনেকখানি দূরে প্রায় দেয়াল-জোড়া একটা পিয়ানোর সম্মুখে একটি তরুণী একমনে কি একটা গানের বইয়ের পাতা উন্টাইতে ব্যস্ত,