পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কীৰ্ত্তিক এমন একটি বিধিবদ্ধ জ্ঞানের পরিচয় পাইয়া আমি অল্প উৎসাহ ও বিস্তর কৌতুহল অনুভব করিলাম, ভাবিয়াছিলাম জীবনকে আর তাড়না করিব না ; একটা অলসস্বচ্ছন্দ ঔদাসীন্যে পৰ্ব্বতবনানীর শোভা অবসরমত একটু একটু করিম ভোগ করিব । কিন্তু আচারিয়ার সে অবসর ছিল না। সে মান্দ্রাজ হইতে আসিয়াছে। তাহার মেয়াদ তিন দিন। এই তিন দিনের মধ্যে দার্জিলিঙের যাহা-কিছু দ্রষ্টব্য, যাহ-কিছু জ্ঞাতব্য, যাহা-কিছু ক্রেতব্য সে সারিয়া ফেলিতে চায় । অতএব আমাকেও বাহির হইতে হইল । অবজারভেটরি পাহাড়ে যাইবার পথে আচারিয়া ভূতত্ত্ববিদ্যার আলোচনা আরম্ভ করিল। আমি প্রথমেই স্বীকার করিলাম যে এক পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করা ছাড়া তাহার সম্বন্ধে আমি কোন খোজই রাখি না । কিন্তু সে সহজে ছাড়িবার পাত্র নহে, ভারতবর্ষে দাক্ষিণাত্যই যে প্রাচীন ভূমি, হিমালয়ের জন্ম যে সেদিনকার কথা, সমুদ্রগর্ভে যে মহা মহাদেশ নিমজ্জিত রহিয়াছে ইত্যাদি তত্ত্ব সে নানাবিধ পুথিপত্রের উক্তিদ্বারা প্রমাণ করিতে উদ্যত হইল। আমি ঈষৎ হাসিয়৷ প্রথমেই সমস্তটা স্বীকার করিয়া লইয়া নিস্কৃতি লাভ করিতে চেষ্টা করিলাম। কিন্তু সে নিরস্ত হইল না। এই সব বৃহৎ বৃহৎ অবশ্বজ্ঞাতব্য তথ্য ছাড়িয়া সে ক্রমশ ইউরোপীয় ও ভারতীয় ভূবিদ্যার যুগ-বিভাগ, স্তরীভূত আগ্নেয় ও পরিবর্তিত প্রস্তরের বয়স ও সংস্থিতি প্রভৃতি নিতান্ত নীরস বিষয়ের অবতারণা করিল। বাধ্য হইয়া বলিলাম, “আচারিয়া, তুমি অন্য বিষয়ের আলাপ কর।” আমরা তখন পাহাড়ের উপরে উঠিয়াছি এবং যথারীতি কুয়াশাচ্ছন্ন দিওঁ মণ্ডলের দিকে হতাশভাবে তাকাইয়া শিখরসমূহের পরিচয়জ্ঞাপক মানচিত্রের আলোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছি, কিন্তু আচারিয়া কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ না হইয়া পাৰ্ব্বত্য দেশে মেঘ ও ৫য়াশার স্থিতি ও সংঘটন, বায়ুচাপ ও স্বৰ্য্যকিরণের তারতম্য, *লোকরশ্মির রাসায়নিক গুণাগুণ ইত্যাদি সম্বন্ধে আলোচনা *iবতে চাহিল। অন্ত লোক হইলে এত ক্ষণ সহ করা দায় হইত, কিন্তু সত্য বলিতে কি আচারিয়ার এই সব তথ্য বলিবার শল্য এমন একটি সহজ স্বচ্ছন্দত থাকিত ষে মুহূর্বের জন্যও মনে হইত না সে নিজের বিদ্য ফলাইতেছে। এমন ভাবে পে বলিয়া যাইত যে এগুলি নিতান্তই অবগুজ্ঞাতব্য তত্ত্ব, মুক্তি మN9 পৃথিবীর সকলেই জানে আমি কেবল বিনয় বশতঃ স্বীকার করিতেছি না। সে স্পষ্টই স্বীকার করিল যে সে আমার সৌজন্যে এবং বিশেষ করিয়া আমার পোষাক পরিবার অনাড়ম্বর শালীনতায় মুগ্ধ হইয়াছে। সমস্ত রাস্ত ধরিয়া সে কেবলই “কোনিফেরাস" ও ‘এচুলা’র বৃক্ষের পার্থক্য, হিমালয়ে শাল, পাইন, ম্যাগনোলিয়া রডোডেনড্রন প্রভৃতির সংস্থান, মস, নিচেন ও ফার্ণ ইত্যাদির ইতরবিশেষ সম্বন্ধে আলোচনা করিল। আমি কথার স্রোত ফিরাইতে চেষ্টা করিলাম, কিন্তু পারিলাম না ; অবশেষে ব্ৰহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করিলাম । “আচারিয়া তুমি কি বিবাহিত ?” “না ।” - “কাহাকেও নিশ্চয়ই ভালবাসিয়াছ ; তাই এত দিন বিয়ে কর নাই।” আচারিয়া গম্ভীর হইল এবং ফেলিয়া বলিল –হয়ত । হঠাৎ সন্দেহ হইল এই ক্ষিগ্রগতি, ক্ষুরধারবুদ্ধি সরলপ্রকৃতি বহুভাষী মান্দ্রাজী ব্রাহ্মণ যুবকটি হয়ত শুধুই কেবল ভূতত্ত্ববিদ্যা, উদ্ভিদ-বিদ্যা কিংবা পদার্থবিদ্যা নহে, তাহার জীবনে হয়ত একটা প্রকাও রহস্য লুকাইয়া আছে। তাই কৌতুহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আচারিয়া তোমার ভালবাসার কাহিনী বলিবে ?” “তুমি নিজে কি বিবাহ করিয়াছ ?” “ই ।” একবার ভাবিলাম ব্যাপারটা খুলিয়া বলি । পরক্ষণেই মনে হইল, লাভ কি? এ বিশ্বসংসারে দুঃখ দারিদ্র্য ও ক্ৰন্দন লাগিয়াই আছে, কিন্তু নিজের করুণ কাহিনী পরের নিকট বর্ণনা করিয়া তাহার সহানুভূতি উদ্রেক করিবার মত হাস্যকর আর কি হইতে পারে । বিশেষতঃ মানুষের মনে সময়ে সময়ে আত্মগোপন করিবার একটা অহেতুক আকাজক্ষ জন্মে । যাহা মিথ্যা বলিয়া জানি তাহাই নানা যুক্তি সহকারে প্রমাণ করিতে ইচ্ছা করি। আচারিয়া আমাকে নীরব দেখিয়া আগ্ৰহান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি তোমার স্ত্রীকে ভালবাস ?” “নিশ্চয়ই। জান না আচারিয়া স্ত্রীর ভালবাসা জীবনে কত বড় আশীৰ্ব্বাদ । জীবনের শত দুঃখ দারিদ্র্য উপেক্ষা একটা দীর্ঘনিশ্বাস