পাতা:প্রবাসী (পঞ্চদশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/১১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৯৮ “অবকাশভোগী সম্প্রদায়।” অধ্যাপক ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় “শিক্ষকের আশা ও আকাঙ্ক্ষ" প্রবন্ধে সাবধানতার সহিত সব দিক রক্ষা করিয়া তাহার আশা ও আকাঙ্ক্ষার কথা লিখিয়াছেন। তিনি ঠিক কথাই লিখিয়াছেন। ইউরোপ আমেরিকার অনেক বড় বড় বৈজ্ঞানিক অল্পসময় অধ্যাপনায় দিয়া বাকী সময় গবেষণায় নিয়োগ করিয়াছেন। আমাদের দেশের অধ্যাপকদের মত তাহাদিগকে সপ্তাহে ১৮ হইতে ২৪ ঘণ্টা শিক্ষা দিতে হয় নাই। তবে, অল্পপরিমাণে শিক্ষা দেওয়ায় তাহদের কায্যের কোন ব্যাঘাত হয় নাই ; হয় ত কখন কথন স্থবিধাও হইয়া থাকিবে। এরূপ বড় বৈজ্ঞানিক ও অনেক হইয়াছেন, যাহারা অধ্যাপক ছিলেন না। অবকাশ পাইলে অধ্যাপকমাত্রেই গবেষণা করিতে পারিবেন ব৷ করিবেন, এমন মনে হয় না । যাহারা গবেষণায় দক্ষতা দেখাইবেন, তাহদের অধ্যাপনার কাজ কমাইয়া দিয়া অবকাশ বেশী করিয়া দিলেই চলিবে । এরূপ বন্দোবস্ত করিলে বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজতত্ব, প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণা হইতে পরিবে এবং উংকৃষ্ট গ্রন্থও রচিত হইবার সম্ভাবনা। কিন্তু "অবকাশভোগী" অধ্যাপকদের দ্বারা বা অন্য অবকাশভোগী সম্প্রদায়ের লোকদিগের দ্বারা উংকৃষ্ট কাব্য ব। তদ্বিধ সাহিত্যগ্রন্থ রচিত হইবে কি না বলা কঠিন। বৈজ্ঞানিকদের প্রতিভা এবং কবি প্রতিভা একজাতীয় কি ন, উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্ব বা প্রভেদ কিরূপ আছে, তাহার বিচার না করিয়াও বলা যায়, যে, কবিপ্রতিভার উদ্ভবের অমুকুল অবস্থা যে কি কি তাহা এখনও কেহ নির্দেশ করিতে পারেন নাই। সুতরাং অবকাশভোগ দ্বারা উহার আবির্ভাব ও বিকাশের কোন সাহায্য হইবে কি না বলা কঠিন। হইবে না বলা যায় না, হইবে ও বলা যায় না। “বঙ্গসাহিত্যে মুসলমান রমণীর স্থান ।” এই নাম দিয়া “আল্‌এপ্লাম" নামক নূতন বাঙ্গল মাসিকপত্রে একজন মুসলমান লেখক একটি প্রবন্ধ লিথিয়াছেন। বঙ্কিমবাবু তাহার উপন্যাসগুলিতে যতগুলি মুসলমান eवानी-रेखाष्ठं x\אאס [ ১৫শ ভাগ, ১ম খণ্ড নারীর চরিত্র চিত্রিত করিয়াছেন, তাহার কয়েকটি ইতিহাস বিরুদ্ধ এবং জঘন্য, একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও জঘন্য, এৰা কয়েকটি মুসলমান আদর্শের অম্বরূপ মোটেই নহে, লেখক এইরূপ বলিয়াছেন। তাহার সমুদয় উক্তি সত্য বা মিথ্য কি না, তাহার আলোচনা আমরা করিব না। কেবল এইটুকু বলিব যে তাহার কয়েকটি অভিযোগের যথেষ্ট কারণ আছে। প্রবন্ধটি পড়িলেই বুঝা যায়, নিজের ধৰ্ম্মসম্প্রদায় ছাড়া অন্য সম্প্রদায়ের পুরুধনারীর চরিত্র চিত্রিত করিতে গেলে কিরূপ সাবধান হওয়া দরকার। ভাল মন্দ সব সমাজেই আছে। কিন্তু যখন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মদটা বেশ করিয়া দেখাই মানবপ্রকৃতির বর্তমান অবস্থায় সাধারণ মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক, তখন, সাধারণত:, হিন্দু লেখকের পক্ষে মুসলমান সমাজের এবং মুসলমান লেখকের পক্ষে হিন্দু সমাজের অপকৃষ্ট পুরুষ-ও-নারী-চরিত্র না অাকাই ভাল ; বিশেষত: যখন হিন্দুমুসলমান পরস্পরের গ্রন্থকে দুরভিসন্ধি ও বিদ্বেষ-প্রস্থত বলিয়া বিশ্বাস করিতে সহজেই উন্মুখ। যে প্রবন্ধটির কথা আমরা বলিতেছি লেখক তাহ ধীরতার সহিত লিখিতে পারেন নাই। তিনি এক জায়গায় বলিতেছেন—একমাত্র বাঙ্গালীর “কল্প-লেখনীতেই এই প্রকার বীভৎস পশুভাবনিচয়ের পরিস্ফুটন সম্ভবপর।" অন্য প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য ভাষার সাহিত্যের সহিত লেখকের কতদূর পরিচয় আছে জানি না। আমাদের সামান্য ক্ষে টুকু জানা আছে, তাহাতে অধমতম বাঙ্গালী লেখক মে জগতের সর্বজাতির মধ্যে অধমতম, এরূপ মনে করিতে পারি না। লেখক বাঙ্গালীজাতিকে সকলের চেয়ে অধম মনে করিয়াছেন। আমরা তাহা মনে করি না। জাতির গুণের বিচার উহার শ্রেষ্ঠ নমুনার দ্বারাই করা ভাল, কারণ কোন জাতির মধ্যে কতদূর নীচ লোক আছে, তাহা বলা শক্ত, কিন্তু প্রত্যেক জাতির মহংলোকের মহত্ব সুপরিজ্ঞাত। মহং বাঙ্গালীর নমুনা দুলৰ্ভ নহে। বাঙ্গালীজাতির নিন্দ করিলে ক্লেশ পাই। লেখক যদি নিজেকে বাঙ্গালী মনে করেন, তবে তাহারও ক্লেশ হইবার কথা । ২য় সংখ্যা ] - ভাষার অত্যাচার হাতের কাছেই যাহ থাকে, যাহাকে লইয়া অহরহ কারবার করিতে হয়, তাহার যথার্থ মূল্য ও মর্য্যাদা সম্বন্ধে খুব একটা স্পষ্ট অনুভূতি আমাদের মধ্যে অনেক সময়েই দেখা রায় না। এই দেহটাকে মাটির উপর পাড়াভাবে দাড় করাইয়া রাখা যে কতটা অচিন্তিত নৈপুণ্যের পরিচায়ক, ও প্রতিমুহূর্তে তাহার পতনের সম্ভাবনাকে অক্লেশে এড়াইয়া চলীয় গণিতের কত জটিল তর্ক যে পদেপদেই অতর্কিতে মীমাংসিত হইয়া যায়, তাহার বিস্তৃত হিসাব লইতে গেলে এ ব্যাপারের গুরুত্ববোধে হয়ত আমাদের চলাফিরার স্বাচ্ছন্দা নষ্ট হইবার সম্ভাবনা ঘটিত। তেমনি, কতকগুলা কৃত্রিম অযৌক্তিক ধ্বনির সংযোগে কেমন করিয়া যে আমার মনের নাড়ী-নক্ষত্র সমস্ত দশজনের কাছে প্রকাশিত হইয় পড়ে, তাহার স্বত্রাম্বেষণ করিতে গেলে মনে হইতে পারে যে এত বড় আজগুবিস্থাও ঝি আর কিছু নাই। গাধা শৰটা উচ্চারণ করিবা মাত্র দশজন লোকে কোন চতুষ্পদবিশিষ্ট সহিষ্ণু জীবের কথা ভাবিতে লাগিল! নিমন্বিতের পেটে যে ক্ষুধানল জলিতেছে তাহ কেহ দেখে নাই ; কিন্তু সে লুচি লুচি বলিয়া বাতাসে একটা তরঙ্গ তুলিবামাত্র চক্রাকার স্বতপক দ্ৰব্যবিশেষ দেখিতে দেখিতে তাহার পাতে হাজির ৷ অথচ এসকলের কোন ন্যায়সঙ্গল সাক্ষণং কারণ দেখা যায় না ; কারণ নামের সঙ্গে নামীর সাদৃশ্ব বা সম্পর্ক যে কোথায়, তাহ জাজপধ্যস্ত কেহ নির্দেশ করিতে পারে নাই। স্বতরাং বলিতে হয়; ভাষা জিনিষটা গোড়া হইতেই একটা কৃত্রিমতার কারবার। কিন্তু তাই বলিয়া ভাষার ব্যবহারে কেবা নিরস্ত থাকে । স্ববিধার খোজ করিতে গেলেই তাহার আস্থাযঙ্গিক দুচারটা অসুবিধা স্বীকার করিতেই হয়। স্ববিধার খাতিরে আজ একটা জিনিষকে স্বীকার করিয়া লইলে দুদিন বাদে সে কিছু-না-কিছু অন্যায় দাবী করিবেই। কার্ধোর স্বব্যবস্থার জন্যই লোকে নানারূপ কাৰ্য্যপ্রণালী ও নিয়মতন্থের প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু কাৰ্য্যত অনেক সময়ে তাহার ফল দাড়ায় ঠিক উন্ট। যেটা উপলক্ষ্য থাকা দরকার wo ভাষার অত্যাচার 3SS ^^^ সেইটাই একটা প্রধান লক্ষ্য হইয়। নূতন কতগুলা অস্থবিধার কেন্দ্র হইয়া দাড়ায়। সমাজের এক-একটা বিধিব্যবস্থা মূলত স্বযুক্তিপ্রতিষ্ঠিত হইলেও, কালক্রমে অস্কারকম ব্যাপকতা ও ঔদ্ধত্য লাভ করিয়া তাহারা কিরূপে পুরুষপরম্পরা মাহুষের সহজবুদ্ধির ঘাড়ে চাপিয়া বসে, আমাদের দেশে তাহার ব্যাখ্যা বা দৃষ্টাস্তের আড়ম্বর নিম্প্রয়োজন। যে কারণে মানুষ শাস্ত্রব্যবস্থার উদ্দেশ্বকে ছাড়িয়া তাহার অস্থশাসন লইয়াই সস্তুষ্ট থাকে, ঠিক সেই কারণেই মানুষের চিন্তা আপনার উদ্দিষ্ট সার্থকতাকে ছাড়িয়া কতগুলা বাক্যের আশ্রয়ে নিশ্চিস্ত থাকিতে চায়। এ অবস্থায় বাক্য ষে মাথায় চড়িয়া বসিবে তাহাতে বিচিত্র কি ? সব জিনিষেরই একটা সোজাপথ বা shortcut খুজিবার চেষ্টা মাহুষের একটা অস্থিমজ্জাগত দুর্বলতা। কোন একটা চিন্তাধারার আদ্যোপাস্ত অনুসরণরূপ দুরূহ কাৰ্য্যকে সংক্ষেপে সারিবার জন্য আমরা মোটামুটি কতগুলা শ্রুতি বা আপ্তবাক্যের আশ্রয় লইয়া মনে করি ঐসকল তত্বের সহিত যথেষ্ট ঘনিষ্ঠত স্থাপিত হইল। ডারউইনের Evolution Theory ai wfw«tf*<fr জিনিষটা যে কি, সেটা অনুসন্ধান করা আবশ্বক বোধ করি না, কিন্তু Evolution বা অভিব্যক্তি কথাটাকে আমরা খুব বিজ্ঞের মত গ্রহণ করিয়া বসি ; এবং আবশ্বক হইলে ও-বিষয়ে সাবধানে দুচারটা মতামত যে ব্যক্ত করিতে না পারি এমন নয় । কথায় বলে “ঘোড়া দেখলেই থোড়া হয়।" ভাষাৰূপ বাহনটার খাতিরে চিন্তা যে কেমন করিয়া পঙ্গুত্ব লাভ করে তাহার দৃষ্টাস্তের ছড়াছড়ি চারিদিকেই। যে-কোন জটিল জিনিষকে কতগুলা পরিচিত নামের কোঠায় ফেলিয়া লোকে মনে করে বিষয়টার একটা নিম্পত্তি করা গেল। ইংরেজি গীতাঞ্জলি পাঠ করিয়া একজন ইংরেজ আকাশপাতাল ভাবিয়া অস্থির যে এই লেখাগুলিকে তিনি কোন পৰ্য্যায়ভুক্ত করিয়া কি ভাবে দেখিবেন! পরে যখন তাহার খেয়াল হইল যে এণ্ডলাকে Mystic idealism বা ৰূপ একটা কিছু বলা যাইতে পারে তখন তাহার সমস্ত উৎকণ্ঠা দূর হইল এবং তিনি এমন একটা নিশ্চিন্ততার ভাব প্রকাশ করিলেন যেন তাহার আর কিছু বুঝিতে বাৰী নাই।