পাতা:প্রবাসী (পঞ্চদশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

>8や পরিচালনের কৌশল সব শিখিয়া লইল, সাহেবটি নিজেও একজন গাড়ী-চালক। আন্দুর কার্য্যদক্ষতায় সস্তুষ্ট হইয়৷ . সাহেব কলিকাতায় উচ্চ বেতনে তাহার একটি চাকরী ঠিক করিয়া দিলেন, কিন্তু পিতার দোকান ছাড়িয়া আন্দু কলিকাতায় গেল না। যথাসময়ে মক্কায় গিয়া তীর্থ দর্শন শেষ করিয়া পিতা ভগ্নস্বাস্থ্য হইয়া দেশে ফিরিলেন । পুত্র যথেষ্ট ধার ফের করিয়া, প্রাণপণে পিতার সেবা শুশ্ৰুষা করিল। কিন্তু বৃথা, কিছুদিন ভূগিয়া পিতার মৃত্যু হইল। পিতৃশোক আন্দুর বড় লাগিল। কিছুদিন উদভ্রাস্তের মত কাটাইয়া, অবশেষে দেন। পরিশোধে মনোযোগী হইল। দোকান বিক্ৰী করিয়া দেন৷ শুধিয়া হাতে কিছু টাকা জমিতেই, সে নিশ্চিন্ত হইয়। কলিকাতায় গিয়া মোটরকারের সবিশেষ তত্ত্ব শিক্ষা করিল। উচ্চ বেতনে চাকরীও জুটিল। কিন্তু সেই সময় ভাগলপুরে চৌধুরী-সাহেব নূতন গাড়ী কিনিয়াছেন শুনিয়া, সে কলিকাতার চাকরী ছাড়িয় এখানে আসিয়া অল্প বেতনে ঢুকিল। তদবধি এইখানেই আছে। সে প্রায় এক বৎসরের কথা । তাঙ্গর পর কার্য্যগুণে সন্তুষ্ট হইয়া চৌধুৰী-সাহেব তাহার বেতনও কিছু বাড়াইয়াছেন। বেহিসাবী দানবাহুল্যে মাসান্তে তাহার হাতে কিছুই জমিতে পায় না,—দেখিয়া শুভাকাঙ্ক্ষী চৌধুরী-সাহেব তাহার বেতনের অৰ্দ্ধাংশ কাটিয়া রাখিতেন। আন্দু এখন পর্যন্ত অবিবাহিত, হিতৈষী প্রভূর ইচ্ছ, তাহার কিছু অর্থ জমিলেই, বিবাহ দিয়৷ গৃহস্থালি পাতাইয়া দিবেন। আন্দু শুনিয়া নীরবে হাসিত। ( २ ) আন্দু ঘোড়া লইয়া ফিরিয়া আসিয়া রহিম খাকে ঘোড়া দিল। রহিম ঘোড়া লইয়া আস্তাবলে যাইতে আন্দুও পিছু পিছু গেল। এদিক ওদিক চাহিয়া নিম্নস্বরে বলিল, “চাচা, আমার দুধটা এসেছে কি ?” প্রভূর গৃহ হইতে আন্দুর দেড় সের দুগ্ধ বরাদ্দ ছিল। রহিম খুঁটায় ঘোড়ার দড়ি পরাইতেছিল, মাথা তুলিয়া মুখ ফিরাইয় বিরক্ত স্বরে বলিল, “কি ?” আন্দু ক্লিষ্টশ্বরে বলিল, “দুধটা এসেছে কি ?” “স্থা, কারুর চাই নাকি ?” - প্রবাসী—বৈশাখ, ১৩২২ [ ১৫শ ভাগ, ১ম খণ্ড আন্দু অপ্রতিভ হইয়। হাসিল—“গুরুদয়ালের বড় ಇಇ: יין অস্থখ—” “সে ত সবাই জানে। দুধ তাকে দিতে হবে ?" “হা, চুপ কর, একটু আস্তে, কেউ শুনতে পাবে—” “তোমার তো নিত্যি খয়রাতি কারখানা, বিলুতেই সব ৷ যায়, এর আর ঢাকঢ়াক কি ? নিয়ে যাও, ওঘরে' চ | দুধ আছ। সবট চাই ?” “না তুমি একটু খেয়ো—” বলিয়া আন্ ঘর হইতে । দুগ্ধের পাত্র লইয়া তখনি বাহির হইয়া গেল । - রহিম রাগ করিয়া বলিল, “ঘোড়া টহল দিতে যাওয়া | তো নয়, রাজ্যির লোকের খোজ নিতে যাওয়া । বাদশজাদার ব্যাট, না খেয়েই মরবে ! আরে বাপু, তুই যখন মরবি, তখন কে তোর খবর নেবে " ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা ভাবিবার সময় ছিল না, আৰু তখন বৰ্ত্তমান লইয়া বাস্ত । অল্পক্ষণ পরে শূন্য দুগ্ধপাত্রটি পুকুর হইতে ধুইয়। মুছিয়া আনিয়া রহিমের ঘরে উপুড় । করিয়া রাখিয়া বস্ত্র পরিবর্তনের জন্য নিজের ঘরে গেল । আন্দু রহিমের কাছে আহারাদি করিত। আন্দু নিজের ঘর হইতে গায়ের ঘাম মুছিয়া জামা | বদলাইয়া তোয়ালে কাধে ফেলিয়া হরিহর খানসামার কাজ u করিতে উপরে চলিল। বাহিরের সিড়ি দিয়া বৈঠকখানায় । যাইতে হয়। অন্ধেক সিড়িতে উঠিয়াছে এমন সময় দেখিল । লতিকার সহিত জ্যোৎস্ন দেবী সিড়ি দিয়া নামিতেছে। । জ্যোংস্কা লতিকার সহাধ্যায়িনী, পিতাঁর বন্ধকন্ত। ' জোংস্কার পিতা হাইকোটের উকিল। জ্যোৎস্না লতিকার সহিত ছুটিতে ভাগলপুরে বেড়াইতে আসিয়াছে শীঘ্রই ; চলিয়া যাইবে । জ্যোৎস্ব লতিকা অপেক্ষা বয়সে কিঙ্কিং ছোট, সে বিবাহিত । তাহার স্বামী বিবাহের পরই আমেরিকায় ইঞ্জিনীয়ারী শিখিতে গিয়াছে । তাহাদের দেখিয়া আন্দু সিড়ি হইতে নামিয়া নীচে আসিয়া দাড়াইল। লতিকা নামিতে নামিতে হাই তুলিয়া বলিল, “তুমি কি বাবাকে আনতে যাবে কাছারী থেকে " নত দৃষ্টিতে আন্দু বলিল, “আজে ই৷” "এলে গাড়ীখানা ঠিক করে রেখ, আমরা রোদ পড়লে বেড়াতে যাব।" ১ম সংখ্য। ] জ্যোংস্ক মৃদুস্বরে বলিল, “বাগানে যাচ্ছ বটে, কিন্তু যে রোদ, পুড়ে মরুতে হবে।" লতিক বিদ্রুপের হাসিতে বলিল, “পুড়েই তো মৰ্বছ।" অর্থ বুঝিয়া জ্যোংস্কা ঈষৎ হাসিল। আন্দু সসঙ্কোচে আরো একটু সরিয়া দাড়াইল । তরুণীদ্বয় নামিয়া বাগানের দিকে বেড়াইতে গেল। আন্দু ছাপ ছাড়িয়া, পিঁড়ি ভাঙ্গিয়া, ঘরে ঢুকিল। প্রসন্ন চিত্তে শীস, দিতে দিতে ঘরের কাজ আরম্ভ করিল। ক্ষিপ্ৰ হস্তে ঘর দ্বার টেবিল চেয়ার ঝাড়িয়া ঝুড়িয়া সমস্ত পরিপাটী রূপে সাজাইয়া গুছাইয়া, আলমারির পুস্তকরাশির পানে সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া আলস্য ভাঙ্গিল। সমস্ত পৃথিবীর কোন জিনিসের দিকে তাহার দৃষ্টি নাই, তাহার ত লোভ ঐ বইগুলির দিকে ; মাঝে মাঝে দুই একথান। বই লইয়া গিয়া লুকাইয়া পড়িবার চেষ্টা করিত, দুরূহ শব্দার্থ অভিধান দেখিয়া বুঝিয়া লইত ; বিষয় লইয়া আইনের মারপ্যাচ তাঙ্গর অত্যন্ত নীরস ঠেকিত, তবু তাহাও পড়িতে ছাড়িত না। যাহা জানে না, তাহাই জানিবার জন্য তাহার দুর্জয় ঝে কি! সামান্য বিদ্যা হইলেও সেক্সপীয়ারও তাহার হস্তে পরিত্রাণ পান নাই । সে গভীর রাত্রে দ্বার রুদ্ধ করিয়া প্রদীপ জালিয়া ঐসব করিত। কোন কোন দিন পড়ার কোকে সারারাত্রি কাটিয়া যাইত ; পরদিন তাহার নিদ্রাহীন শুদ ক্লিষ্ট মুখ দেখ্রিয়া কেহ যদি জিজ্ঞাসা করিত “তোমার কি জর হইয়াছে ?” তাহা হইলে আন্দু তৎক্ষণাৎ জবাব দিত, "আঙ্গে ই. সমস্ত রাত, ভোর বেলা ছেড়েছে!” - বইগুলির দিকে চাহিয়া, নিজের দুৰ্ব্বদ্ধিজাত ছেলেমামুণীর কথা ভাবিতে ভাবিতে আন্দুর হাসি পাইল । তাহার বন্ধুরা তাহার আচরণে বিরক্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিত— "আমাদের পড়ে কি হবে ?”—কি যে হইবে, সে প্রশ্নের উত্তর খুজিতে আন্দু আকুল হইয়া উঠিত, অনেকগুলা উত্তর হুড়াছড়ি করিয়া ঠোঁটের কাছে ঠেলিয়া আসিলে, ঠাং সব কটাকে নিরস্ত করিয়া অপরাধীর মত কুষ্ঠিত হাসি হাসিয়া বলিত, “কি যে হয় তা জানি না, ভাল লাগে তাই পড়ি ” সেখ আন্দু ›8ዳ - تمبر سر مرمر বন্ধুরা মন্তব্য প্রকাশ করিত, “যাকে গাড়ী চালিয়ে থেতে হবে, তার আবার লেখাপড়া কেন ?” - আন্দু কোমল ভাবে বলিত, “কি জানি দাদা, মনে করি পড়ব না, কিন্তু ছাড়তে পারি না! ও যেন নেশার মত আমায় পেয়ে বসেছে !” অনেকে ইহাতেই চুপ করিয়া যাইত, অনেকে বিন্দ্রপ ব্যঙ্গ করিত, আন্দু সন্ত্রস্ত হইয়া বলিত, “আরে চুপ, চুপ, এইবার সব ছেড়ে দেব, অাব পড়ব না !"— নিজের নিষ্ফল। বিদ্যার জন্য, সে শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলের কাছেই মাথা হেঁট করিয়া থাকিত। দর্জির ছেলে হইয়া কেন সে ঐটুকু লেখাপড়া শিথিয়াছিল! পরিতাপের মধ্যে সন্তোষ টানিয়া সে আপনার মনকে আপনি সাস্বনা দিত,—সে ত তোতা-পার্থীর মত মুখস্থ কোটেশ্বন কাটিয়া বিদ্যার প্রাণহীন বড়াই করিতে চায় না, সে ত শুধু চায় পাচজন ভাল লোকের কাছে উপদেশ ! মনকে একটু উন্নত করিতে ! ইহাতে কি খুব বেশী দোষ আছে ? ভাবিতে ভাবিতে বন্ধুদের “কি হয় ?" প্রশ্নের একটা নূতন উত্তর আব্দুর মনে সদ্য জন্মলাভ করিল। “কি হয় ?” উত্তর “কি হইবে ? কিছুই না, অস্তত: পৃথিবীর তো কোন অপকার নাই!” নিজের মনের মধ্যে ঝগড়া-ঝণটিতে খানিক সময় অন্যায় ভাবে কাটিল দেখিয়া, আন্দুর আহুতাপ হইল। ঘরের ধূলাগুল তুলিয়া বাহিরে ঝাটাইয়া ফেলিয়া, সিড়ি ঝাট দিতে দিতে নীচে নামিয়া আসিল। সমস্ত জঞ্জাল তুলিয়৷ বাহিরে ফেলিয়া যখন সে মুখ তুলিয়। চাহিল, তখন দেখিল, বাগানে দাড়াইয়া তরুণীরা তাহাকে লক্ষ্য করিয়েছে। কুষ্ঠিত আন্দু তাড়াতাড়ি ঝাটা তুলিয়া লইয়া চলিয়া গেল। ঘরে গিয়া গায়ের ধূলা ঝাড়িতে ঝাড়িতে হাস্যমুখে ভাবিল, হৌক, পরের জন্য ঝাটা ধরিয়াছে, তাহাতে যাহার খুসি উপহাস করুক অবজ্ঞা করুক, তাহাতে দুঃখ করিলে চলিবে না ! নিজের সখের জন্য অনেকেই বাডসাই টানে, কিন্তু পরের স্বথের জন্য কেহ কি আগুনে ফু দিতে যায় ? ENG তাহার নিজের সখের উৎকট আমোদ ! আন্দু মুখ ফুটিয়া হাসিয়া ফেলিল। ঘরে অন্য কেহ ছিল না, থাকিলে তাহার অকারণ হাস্য দেখিয়া কি মনে করিত ?