পাতা:প্রবাসী (পঞ্চবিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৬৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৬১২ [ ২৫শ ভাগ, ১ম খণ্ড শাস্ত্র, ধাৰ্ম্মিকদের বাধা নিয়মের আচার তাদের কাছে স্বগম ছিল না। বাইরের পূজার মন্দির তাদের কাছে বন্ধ ছিল ব’লেই অস্তরের মিলনমন্দিরের চাবি তার খুঁজে পেয়েছিলেন । তারা কত শাস্ত্রীয় শব্দ আন্দাজে ব্যবহার করেছেন, শাস্ত্রের সঙ্গে তার অর্থ মেলে না । তাদের এই প্রত্যক্ষ উপলব্ধির রাম কোনো পুরাণের মধ্যে নেই। তুলসীদাসের মত ভক্ত কবিও এদের এই বাধনছাড়া সাধন ভজনে ভারি বিরক্ত । তিনি সমাজের বাহ বেড়ার ভিতর থেকে এদের দেখেছিলেন, একেবারেই চিনতে পারেননি । এরা হলেন এক বিশেষজাতের মানুষ। ক্ষিতিবাবুর কাছে শুনেছি, আমাদের দেশে এদের দলের লোককে বলে থাকে “মরমিয়া।” এদের দৃষ্টি, এদের স্পর্শ মর্শ্বের মধ্যে ; এদের কাছে আসে সত্যের বাহিরের মূৰ্ত্তি নয়, তার মর্শের স্বরূপ । বাধা পথে র্যার সাবধানে চলেন তারা সহজেই সন্দেহ করতে পারেন যে, এদের দেখা এদের বলা সব বুঝি পাগলের খামখেয়ালি। অথচ সকল দেশে সকল কালেই এই দলের লোকের বোধের ও বাণীর সাদৃঙ্গ দেখতে পাই। সব গাছেরই দেখি কাঠের থেকে একই আগুন মেলে। সে আগুন তারা কোনো চুলো থেকে যেচে নেয়নি—চারদিকৃ থেকে আপনিই ধ’রে নিয়েছে। গাছের পাতায় স্থধ্যের আলোর ছোওয়া লাগে,অম্নিই এক জাগ্রৎ শক্তির জোরে বাতাস থেকে তারা কাৰ্ব্বন ছেকে নেয়, তেমনি মানবসমাজের সর্বত্রই এই মরমিয়াদের একটি সহজ শক্তি দেখা যায়, উপর থেকে তাদের মনে জালো পড়ে আর তার চারদিকের বাতাস থেকে আপনিই সত্যের তেজোরূপটিকে নিজের ভিতরে ধ’রে নিতে পারেন, পুথির ভাণ্ডারে শাস্ত্রবচনের সনাতন সঞ্চয়ের থেকে কুড়িয়ে বুড়য়ে তাদের সংগ্রহ নয়। এই জন্তে এদের বাণী এমন নবীন, তার রস কখনো শুকোয় না । জনস্তকে ত জ্ঞানে কুলিয়ে ওঠে না,—ঋষি তাই বলেন, তাকে না পেয়ে মন ফিরে আসে ! সেই জনষ্ণের সমস্ত রহস্ত বাদ দিয়ে উঁাকে সম্প্রদায়ের ঈশ্বর, শাস্ত্রবাক্যের ঈশ্বর, কবুলতিপত্রে দশে মিলে দস্তখতের দ্বারা স্বীকার করে-নেওয়া, হাটে বাটে গোলে হরিবোলের ঈশ্বর ক’রে নিই। সেই বরদাতা, সেই ভ্ৰাণকৰ্ত্ত, সেই স্বনির্দিষ্টমতের ফ্রেম-দিয়ে বাধানো ঈশ্বরের ধারণা একেবারে পাথরের মত শক্ত ; তাকে মুঠোয় ক’রে নিয়ে সাম্প্রদায়িক ট্যাকে গুজে রাখা চলে, পরস্পরের মাথা ভাঙাভাঙি করা সহজ হয়। আমাদের মরমিয়াদের ঈশ্বর কোনো একটি পুণাভিমানী দলবিশেষের সরকারী ঈশ্বর নন, তিনি প্ৰাণেশ্বর । কেননা ঋষি বলেচেন, জ্ঞানে তাকে পাওয়া যায় না, আনন্দেই তাকে পাওয়া যায়। অর্থাৎ হৃদয় যখন অনস্তকে স্পর্শ করে তখন হৃদয়মন তাকে অমৃত ব’লে বোধ করে, আর এই নিবিড় রসবোধেই সমস্ত সংশয় দূর হয়ে যায়। শেলি সেই বোধের গানই গেয়েছেন,মরমিয়া কবিদের কণ্ঠে সেই বোধেরই গান। যা রহস্ত, জ্ঞানের কাছে তা নিছক অন্ধকার, তা একেবারে নেই বললেই হয় । কিন্তু যা রহস্য, হৃদয়ের কাছে তারই আনন্দ গভীর । সেই আনন্দের দ্বারাই হৃদয় অসীমতার সত্যকে প্রত্যক্ষ চিনতে পারে । তখন সে কোনো বাধা রীতি মানে না, কোনো মধ্যস্থের ঘটকালিকে কাছে ঘোষতে দেয় না। অমৃতের রসবোধ যার হয়নি, সেই মানে ভয়কে ক্ষুধাকে, ক্ষমতাকে । সে এমন একটি দেবতাকে মানে, যিনি বর দেন, নয় দণ্ড দেন। র্যার দক্ষিণে স্বর্গ, বামে নরক । যিনি দূরে বসে কড়া ছকুমে বিশ্বশাসন করেন। যাকে পশুবলি দিয়ে খুসি করা চলে, ধার গৌরব প্রচার করবার জন্তে পৃথিবীকে রক্তে ভাসিয়ে দিতে হয়, র্যার নাম ক’রে মানবসমাজে এত ভেদবিচ্ছেদ, পরম্পরের প্রতি এত অবজ্ঞা, এত অত্যাচার। ভারতের মরমিয়া কবিরা শাস্ত্রনিৰ্ম্মিত পাথরের বেড়া থেকে ভক্তের মনকে মুক্তি দিয়েছিলেন । গ্রেমের অশ্রজলে দেবমন্দিরের অঙ্গন থেকে রক্তপাতের কলঙ্করেখা মুছে দেওয়া ছিল তাদের কাজ। ধার আবির্ভাব ভিতরের থেকে আনন্দের আলোকে মানুষের সকল ভেদ মিটিয়ে দেয়, সেই রামের দূত ছিলেন তারা । ভারতইতিহাসের নিশীথরাত্রে ভেঙ্গের পিশাচ যখন বিকট নৃত্য করছিল তখন তারা সেই পিশাচকে স্বীকার করেননি।