পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SS8 “যদি পরাণে না জাগে সেই আকুল পিয়াস, পায়ে ধরি, ভাল বেসো ন৷ ” মহামায়া রাগ করিয়া বলেন, “লক্ষ্মীছাড়া ছেলে, আর গান খুঁজে পাস না ? তোর বাবা যে রোজ সকালে গান করেন তার একটা শিখতে পারলি না, সবার আগে ওই মেসের ছেলেদের গানগুলো মাথায় ঢুকল ” শিবু বলে, “ওদের গান ভেঙাতে আছে, বাবার গান ভেঙাতে নেই।” স্বধার কানে মহানগরীর বাণী দিনরাত্রি আসিতেছে, কিন্তু সে বাণীর সহিত তাহার বাণীর আদান-প্রদান নাই । মহামায়া হাটিতে চলিতে কষ্ট পান, তাই পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে ভাব করা হয় নাই, পাড়ার মেয়েরাও কেবল স্থধার মত ছেলেমাতুষকে দেখিয়া বেশী আসিবার আগ্রহ দেখায় না। স্বধা গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলিতে ত লজ্জাই পায় ; কিশোরীদেরও পাউডার-শোভিত মুখ, চওড়া রঙীন ফিতার ফাস বাধা বিমুনি এবং ফাপানো এলো খোপার পারিপাট্য দেখিয়া কাছে যাইতে ভরসা হয় না । মহামায়া বলেন বটে, “হ্যারে, ইস্কুলে টিস্কুলে ভর্তি হবি, এইসব মেয়েদের একটু জিগেস করিসূ, কোথায় কেমন পড়ায়-টড়ায় ?” স্বধা বলে, “সে সব আমি পারব না, তোমরা যেখানে হয় ভৰ্ত্তি করে দিও ” চন্দ্রকান্ত জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “মেয়েকে ফিরিঙ্গি ইস্কুলে দেবে নাকি গো, খুব কায়দাছুরস্ত ইংরিজী বলতে পারবে । বাড়ীওয়ালার মেয়েরা ত যায়ই, সেই সঙ্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারি।” মহামায়া বলিয়াছিলেন, “না বাপু, আমার গরীবের অত ঘোড়া-রোগে কাজ নেই। গোছা গোছ টাকা মাইনে, পোষাক, গাড়ী ব’লে গুনবে কোথা থেকে ? তুমি একটু ইস্কুলের পর পড়িও টড়িও, তাহলেই যা সাদা-মাটা শিখবে তাইতেই আমাদের গেরস্তর ঘর চলে যাবে।” চন্দ্রকান্ত বলিলেন, “কিন্তু ষে গেরস্তর বাড়ী যাবে তার যদি মন না ওঠে ?” মহামায়া বলিলেন, “না ওঠে নিজের ঘরের ভাত বেশী করে থাবে, তাই বলে ঋণ-কৰ্জ করে আমি এখন থেকে পরের মন যোগাতে পারব না।” ১৩৪৩ চন্দ্রকান্ত বলিলেন, “তবে ত তুমি ভারি বাঙালীর মেয়ে ! মেয়ে জন্মাবার দিন থেকে বেয়াই জামাইয়ের মন বুঝে যদি না চললে তবে কলিযুগে জন্মালে কি করতে ?” মহামায়া বলিলেন, “অত গোলামী অামার দ্বারা হবে না বাপু ; আমার মেয়ে আমার থাকবে, কারুর গরজ পড়ে ত সে আপনার গরজেই নিতে আসবে।” চন্দ্রকাস্তের আয় কম, মহামায়ার নজরও সেকেলে, কাজেই মেয়েকে সাধারণ দেশী ইস্কুলেই দেওয়া ঠিক হইল। তবে এই কয়ট মাস বাড়ীতে ইস্কুলের মত গড়িয়া পিটিয়া লইয়া একেবারে ইংরেজী বৎসরের গোড়াতেই ছেলেমেয়ে দুইজনকে স্কুলে দেওয়া হইবে । সাত-আট মাসে মহামায়ার চিকিৎসাও একটু অগ্রসর হইতে পারিবে। কচি ছেলেটাকে ঘাড়ে ফেলিয়া দিয়া স্বধী যদি সারাদিনের মত বিদ্যাচর্চা করিতে চলিয়া যায় তাহা হইলে চিকিৎসকের কথামত ত মহামায় একচুলও চলিতে পারিবেন না। এই ত চার হাত মাচার মত বাড়ী আর এই গড়ানে সিড়ি, ছেলে একবার গড়াইতে মুরু করিলে মনুষ্যাকুতি আর থাকিবে না। তা ছাড়া এক পা ত এখানে সোজা বাড়াইবার জো নাই, নাওয়া, খাওয়া, জল তোলা, ফাইফরমাস সব কাজেতেই কেবল সিড়ি আর সিঁড়ি। এই কটা মাসে যদি ভগবান একটু মুখ তুলিয়া চাহেন তখন না-হয় নিজেই কোনও রকমে সিড়ি ভাঙা যাইবে । এখন অন্ধের হাতের নড়ি কাড়িয়া লওয়ার মত স্বধাকে সরাইলে মহামায়া ত একেবারে অচল । এখানে আসিয়া স্বধা শিবুর সে শৈশব-স্বপ্ন ঘুচিয়া গিয়াছে। পুরুষ জাতি বলিয়া যে ভিন্ন জাতি আছে, তাহাদের খেলাধূলাও যে স্ত্রীজাতির খেলাধূলা হইতে ভিন্ন, শিবু, কলিকাতায় আসিয়া অকস্মাৎ তাহা আবিষ্কার করিয়া ফেলিয়াছে। দিদির সঙ্গে কাল্পনিক মহাসমুদ্র হইতে কাল্পনিক মুক্ত প্রবাল সংগ্রহে আর তাহার উৎসাহ নাই ! গলির ভিতরেই পাড়ার ছেলেদের অতি বাস্তব একটা সাইকেল হইতে বার দশেক আছাড় খাইয়া হাটু ও কনুই ক্ষতবিক্ষত করিয়া একান্ত নিজস্ব একটা সাইকেল সংগ্ৰহ করিবার জন্য সে দিবারাত্রি মার পিছনে লাগিয়াই আছে। অবসর সময়ে হাইজম্প লং-জম্প প্রভৃতি তাহার যাবতীয় নবার্জিত বিদ্যায় সে যে পাড়ার কাহারও অপেক্ষ ছোট নয় তাহাই