পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পোষ করবার চেষ্টা করা বৃথা। সত্যবানের অনেক দিনের শিক্ষা সীমার অন্তরে গভীরভাবে প্রবেশ করেছে ; সত্যবানের মৃত্যুকালীন একদিনের উক্তি তাকে উৎপাটন করবে তার সম্ভাবন৷ কম। তখন সে তর্ক স্বরু করলে ; বললে, “এমনি ক’রে একটা দুটো পাচট খুন করে দেশকে মুক্তি দান করবে, এর চেয়ে বাতুলের কথা কিছু হতে পারে না। ওতে শুধু দেশের লোককেই বিপৰ্য্যস্ত করে তাদের দুঃখের উপরে দুর্দশার কারণ ঘটানো ছাড়া আর কোন উপকার হবে না।” “একটা দেশের উপর লড়াই চললৈ এর চেয়ে অনেক দুঃখদুর্দশা সে-দেশের লোককে ভোগ করতে হয়। স্বতরাং আপাত-দুঃখটাকেই বড় ক’রে দেখবার কোন আবগুক নেই। ভয়েতে সব কিছু মেনে নেবার নিদারুণ উদ্বেগহীনতা থেকে তাদের নির্ভয়ে মাথা তুলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোজা হয়ে দাড়াবার তেজ দিতে চাই আমরা ।” “অষ্ঠায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাড়াবার শক্তি একটা নৈতিক বল। সেটাকে একটা পঞ্চশক্তির মত করে জাগাতে গেলে সেই নৈতিক বলেরই মহামৃত্যু ঘটাবে। কুকুরকে মারলে সে তেড়ে আসে কামড়াতে। আরও জোরে মারতে পারলে সে পালায়—কারণ, পশুশক্তি সে-ক্ষেত্রে যে মারে তার বেশী ; কারণ, পশুত্বের উপরের যে কথা, যা দিয়ে সে মার থেয়েও নিজেকে অচ্চায়ের কাছে হার মানতে দেবে না, কুকুরের তা নেই। তার শক্তির সীমা ঐ পৰ্য্যস্ত। কিন্তু নৈতিক বলের ত কোন সীমা নেই, তাই তাকে ক্রুশে বিদ্ধ করে মারলেও সে জয়লাভ করে ; তাকে মশাল করে পুড়িয়ে মারলেও সে মরে না, হাতীর পায়ের তলায় ফেললেও না । নিতান্ত উত্তেজিত না-হয়ে এই কথাটা যদি ভেবে দেখ যে একটা মৃতকল্প ঘোড়াকে চাবুক মারলেই তাকে দিয়ে কাজ পাওয়া যায় না, তাহলে এই কাটি কোটি দুৰ্ব্বল, নিরন্ধ মূঢ় ভাইবোনদের সম্বন্ধে তোমার মরুশী হবে । সত্যদা বলেছিলেন যে ‘হাজার বছরের চাপে fর শিরদাঁড়া ছয়ে পড়েছে তার মাথা তুলে দাড়াবার শক্তি tাসবে কোখেকে ? সেই বাকী শিরদাঁড়াটার রীতিমত কিৎসা চাই আগে, তা নইলে সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে"। কাধের বশবর্তী হয়ে একথা যদি ভুলে যাই, তবে ক্রোধের ত্রিশ্ৰেণী \లిసి)\9 বিলাসে নরহত্যার পাপেই লিপ্ত হতে হবে, আর কিছু হবে না।” o সীমা চুপ করে থাকে। তার মনের মধ্যে প্রতিহিংসার আগুনে নিখিলনাথের কথাগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সে উত্তেজিত হয়ে নিখিলনাথকে “বিলাতী মোহগ্ৰস্ত" বলে খোচা দেয়। নিখিলনাখ চুপ করে শোনে। ও কথার কোন জবাব দেয় না ; তৰু সীমার আশ্রদ্ধায় তাঁর মন ব্যথায় ভরে ওঠে। সীমা ক্রুদ্ধ মনে ভাবে, এমনি ক’রে ভাবতে গিয়ে চিরকাল আমরা কাপুরুষ হয়ে রইলাম। স্বাধীনতার মুখ আমরা কোনকালেই দেখতে পাব না। চিরকালটা যে তার জীবিতকালেক্ট মাত্র সীমাবদ্ধ নয়, তা তার মন মানতে চায় না। ভাবতে চায় যে, এমন বিপ্লব উপস্থিত করবে যে যার ঝড়ে দেশের সমস্ত দুখ দৈন্ত হীনতা একদিনে উড়ে যাবে এবং নিজ হাতে নিজেদের মুখসম্পদ স্বাধীনতার রাজপ্রাসাদ আলাদীনের প্রদীপের মত এনে প্রতিষ্ঠিত করবে। তার উত্তেজিত মনের এই নাটকীয় কল্পনাকে সে মনে মনে দেশহিতের আসনে প্রতিষ্ঠিত করে এক প্রকার তৃপ্তি পায়, আত্মপ্রসাদ লাভ করে। উত্তেজনার বিলাসে তার মনের পক্ষে অপেক্ষাকৃত জটিল দুরূহ শাস্ত বিচারশীল পস্থাকে স্থির হয়ে চিন্তা করবার ধৈর্য্য তার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। শাস্ত ধীরতাকে সে কাপুরুষতা বলে মনে মনে ঘৃণা করতে থাকে। তবু একল বসে বসে নিপিলের প্রতি নিজের উত্তপ্ত চিত্তের দুর্বাক্যের কথা স্মরণ করে সে লজ্জিত হয়। নিখিলনাথের সমস্ত শাস্ত অকুপক্রত ধারাবাহিক জীবনযাত্রায় দেশের মঙ্গলসাধনের চেষ্টা তার উত্তেজিত চিত্তে যেন প্রহসন বলে মনে হয়। সীমা চায় সে-ক্ষেত্র থেকে তাকে সবলে উৎপাটন করে ছৰ্ম্মদ মৃত্যুপথযাত্রার দুর্ধর্ষ কৰ্ম্মক্ষেত্রের মধ্যে মুক্তি দিতে। নিখিলনাথকে সে ফিরে পেতে চায় তার কৰ্ম্মপ্রেরণার সঙ্গীরূপে ; বুদ্ধির উপর ষে আলোকসম্পাত করবে, হৃদয়ে যে শক্তি সঞ্চার করবে, নিজের প্রাণের অমিত প্রাচুর্ধ্যে দুলঙ্ঘ্য বিপত্তিকে যে ধূলিসাৎ করে দেবে। নিখিলনাথের শাস্ত ধীরতাকে সে উদাসীনতা বলে মনে ক’রে তীব্র আঘাতে তাকে চেতিয়ে তুলতে চায়—কিন্তু তাতে দিনের পর দিন অশান্তি তার বেড়ে চলে । ( कषभः )