খুড়ীমা শ্ৰীবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় খুব বর্ষ নামিয়াছে । দিনরাত টিপ, টিপ বুষ্টি । আমি চণ্ডীমণ্ডপের দাওয়ায় বসিয়া অঙ্ক কষিতেছি । বেলা প্রায় দুপুর ভক্টতে চলিল । বর্ষী-বাদল না হইলে বিনোদ-মাষ্টারের কাছে ছুটি পাওয়া যাইত। কিন্তু কি বাদলাই নামিয়াতে আজ তিন দিন হইতে আমার ভাগ্যে । এমন সময়ে কোথা হইতে একটা ময়লা-কাপড়-পরা লোক আসিয়া চণ্ডীমণ্ডপের সামনের উঠানে দাড়াইল এবং আমার দিকে চাহিয়া ফিক্ করিয়া হাসিল । আজও মনে আছে লোকটার গায়ে একটা ময়লা চিট, কামিজ, খালি পা, রুক্ষ চুল। বয়েস বুঝিবার উপায় নাই, অন্ততঃ আমার পক্ষে । আমি লোকটাকে আর কখনও দেখি নাই, কারণ বাবামা এখানে থাকিলেও, দিদিমা আমায় ছাড়িয়া থাকিতে পারেন না বলিয়া এত দিন ছিলাম মামার বাড়ীতেই । এ-গ্রামে আমি আসিয়াছি বেশী দিন নয় । যখন চলিয়া গিয়াছিলাম তখন আমার বয়স মাত্র ছ-বছর । বিনোদ-মাষ্টার বলিল—কি পয়েশ, কি খবর ? লোকটা উঠানে দাড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজিতেছে দেখিয়া বলিতে গেলাম—আস্থন না ওপরে—— কিন্তু বিনোদ-মাষ্টার আমার কথায় বাধা দিয়া বলিল— কি চাই পরেশ ? লোকটা আর একবার কেমন এক ধরণের হাসিল । এই প্রশ্নের উত্তরে যে-ধরণের হাসা উচিত ছিল তেমন নয়—যেন নিজের প্রশংসা শুনিয়া বিনীত ও লাজুক হাসি হাসিতেছে। ছেলেমানুষ হইলেও বুঝিলাম হাসিটা অসংলগ্ন ধরণের । বলিল—খিদে পেয়েছে। আমার জাঠতুতো ভাই শীডল বাড়ীর ভিতর হইতে চণ্ডীমণ্ডপে আসিয়া উঠানের দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিল— এই যে পরেশ-কাকা কোথায় ছিলেন এত দিন ? লোকটি উত্তরে শুধু বলিল—থিদে পেয়েছে। শীতল বাড়ীর মধ্যে ঢুকিয় এক বাটি মুড়ি আনিয়া লোকটার কোচার কাপড়ে ঢালিয়া দিল । আমি অবাক হইয়া ভাবিতেছি লোকটা কে, এবং এত সম্মানসূচক সম্বোধন করিতেছে শীতল-দ। অথচ বসিতে বলিতেছে না-ই বা কেন, এমন সময় লোকটা একটা কাও করিয়া বসিল । শীতলদা’র দেওয়া মুড়ির এক গাল মাত্র থাইয়া বাকীগুলি একবার রাইট-য়্যাবাউট-টার্ণ করিয়া ঘুরপাক খাইয়া উঠানময় কাদার উপর ছড়াইয়া ফেলিল—সঙ্গে সঙ্গে কি একটা দুৰ্ব্বোধ্য ছড়া উচ্চারণ করিল গান করার স্বরে— গুগলি ঝিমুক ঋখোদার চাল গামছায় বাধি গুগলি বিমুক কা— গুগলি ঝিনুক - গুগলি ঝিনুক - তখনও সে ঘুরপাক খাইতেছে ও ছড়া বলিতেছে, এমন সময় আমার জ্যাঠামহাশয় দুল্লভ রায়—তিনি অত্যন্ত রাশভারী ও কড়া মেজাজের লোক-বাড়ীর ভিতর হইতে চণ্ডীমণ্ডপের পাশে উঠান হইতে অন্দরে যাইবার দরজায় দাড়াইয়া হাক দিয়া বলিলেন—কে চেচামেচি করে দুপুরবেলা ? ও পাগলাটা ? মুড়িগুলো নিলে, তবে কেন ও-রকম করে ফেললে যে বড়—বদমায়েসী করবার আর জায়গা পাণ্ড নি ? বলিয়া তিনি আসিয়া লোকটার গালে ঠাস ঠাস করিয়া কয়েক ঘা চড় মারিলেন, পরে তাহাকে সজোরে একটা ধাক্কা দিয়া বলিলেন—বেরোও এখান থেকে, আর কোনদিন দরজায় ঢুকেছ ত মেরে হাড় গুড়ো করবে।—আমার বলিষ্ঠ জ্যাঠামহাশয়ের ধাক্কার বেগে রোগ ও পাতলা লোকটা খানিক দূর ছিটকাইয়া গিয়া কাদায়-পিছল কোথা থেকে ?
