পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৯৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পারি—হাজার বার পারি। কানাকড়ির মুরোদ নেই, বাপ হয়েছেন । হাসিলাম। এ ছাড়া আর কি করিতে পারি। ঠানদি স্নেহবশে যাহাই বলুন না কেন, আমি ত বুঝি, পরের মেয়ের উপর আমাদের অধিকার কতখানি । ঠানদি রুথিয়া উঠিলেন,—হাসছিস—কিন্তু দেখে নিস বিশ্বনাথ, ওকে আমি জেলে পাঠিয়ে তবে ছাড়ব । এ কি মগের মুল্লুক ? পুনরায় হাসিলাম । ঠানদি থামিতে পারিলেন না—কালকেই তুই জেলার উকিল দিয়ে খুব কড়া এক নোটিস্ পাঠিয়ে দিস। তখনকার মত ঠানদিকে মানিয়া লইলাম। কতকগুলি যুক্তি দেখাইয়া ঠানদিকে নিরস্ত করার চেয়ে এই পথ অবলম্বন করাই আমার কাছে শ্রেয় মনে হইল । ঠানদি পুনরায় কহিলেন, সেদিনে কত যত্ন ক’রে শু্যামলী আমায় রান্না করে খাওয়ালে । চমৎকার মেয়েটার হাত । খাসা রাধে । এ-সব কাজ কি আর পুরুষমানুষের। বলে মা-বাবা সব সময় চোখে চোখে রাখেন, নইলে তোমায় চাট্রি রান্না করে খাওয়াতে আমি রোজ পারি দিদিমা । মেয়েটা একটু রোগ হয়ে গেছে । আহা এমন মিষ্টি ওর কথা-কপট । একটু থামিয়া ঠানদি অন্য প্রসঙ্গে উপস্থিত হইলেন,— একটি ভাল পাত্র জোগাড় করতে পারিস ? মেয়েটার একটা গতি ক’রে দিতাম। ওর বাপ এর বেলায় আপত্তি তুলবে না, সে তুই দেখে নিস্ । কিন্তু দেখিয়া লইবার প্রয়োজন নাই । এ-কথা আমি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করি। শুশমলীর জন্য উপযুক্ত পাত্র তল্লাস করিবার প্রতিশ্রুতি দিয়া সেদিনকার মত ঠানদির হাত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিলাম । কিন্তু প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিবার অবসর আমি পাইলাম না। আমার দীর্ঘ চার বছরের অবকাশ শেষ হইয়া গিয়াছে । সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আমাকে গ্রাম ত্যাগ করিতে হইবে। কথাটা ঠানদিকে সৰ্ব্বপ্রথম জানাইয়াছি। বুঝিলাম না, আমার তিরোধান তাহার কতখানি বাজিবে । তবে এ-কথা ঠিক, এই দীর্ঘ চার বছরে ঠানদিকে যতটা জানিতে পারিয়াছি তাহাতে আমার মনে রফতানি হাহাকার লইয়া পুনরায় কৰ্ম্মক্ষেত্রে চলিয়াছি তার চেয়ে ঠানদি কিছু কম অনুভব করিবেন না । আমি তার মধ্যে পাইয়াছি আমার মায়ের বিকাশ–আমার মায়ের রূপ। o, ঠানদি আর আমার সহিত একটি কথাও বলিলেন না গ্ৰামত্যাগের পুৰ্ব্বে শুঙ্গমলী একবার আমার সহিত দেখা করিতে আসিল । অামায় প্রণাম করিতে গিয়া পায়ের উপর কয়েক ফোটা চোখের জল ফেলিল। এই কি কম পাওয়া। তার ছু-খানি হাত ধরিয়া তুলিয়া বলিলাম, ঠানদির দোড় গোড়ায় অনেক ক্ষণ দাড়িয়ে থেকেও তার সাড়া পেলাম না। একবার দেখা পৰ্য্যস্ত হ’ল না । আমি চুপ করিলাম, খামলী নীরবে নতমুখে দাড়াইয়া রহিল। ঠানদির আজিকার এই প্রকাগু অবহেলা আমাকে চঞ্চল করিয়া তুলিল, আমাকে জোর করিয়া পিছনে টানিতে লাগিল । পুণরায় কহিলাম, আজ এই ক-টা বছরে বেশ বুঝতে পেরেছি তুই ঠানদিকে ভালবাসিস, আমার কথা আলাদা। শেকড় কোথাও গাড়ল না। রক্টলি তুষ্ট, রইল ঠানদি। র্তার যত্ব নিতে চেষ্টা করিস, তোর ভাল হবে বোন । ঝোকের মাথায় কথা-কটি বলিয়া চোখ তুলিয়া দেখি, চোখের জলে শু্যামলীর বুক ভাসিতেছে । আর অপেক্ষা করিলাম না। যাত্রা আমার স্বরু হইল। একদিন যেমন অকস্মাৎ এদের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছিলাম আজ আবার তেমনি অকস্মাৎ এদের ছাড়িয়া চলিলাম। কিন্তু এই আসা যাওয়ায় কত প্রভেদ | গ্রামকে কোনদিনষ্ট ভালবাসি নাই । আজ ও হয়ত গ্রামের প্রতি ততটা আকর্ষণ নাই । তবুও যেন মন রুথিয়া দাড়াইয়া বলিতেছে “ফিরে চল’। ফিরিয়া যাওয়া হইল । মা, কিন্তু বুকের মধ্যে আঁকিয়া লইলাম শুামলী ও ঠানদিদিকে ঠিক পাশাপাশি । যদি কখনও ফিরিয়া আসি তা কেবল এদেরই জন্ত । গ্রাম্য উচুনীচু রাস্ত ধরিয়া গরুর গাড়ী অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে। মাথা নীচু করিয়া আমার গ্রামের জীবনযাত্রার একটা হিসাব করিতেছিলাম আর ভাবিতেছিলাম হ্যামলীর কথা, ভাবিতেছিলাম ঠানদির কথা। এমনি করিয়াই মানুষ । সংসারকে ভালবাসিয়া ফেলে।