পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/২৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভাষারহস্য শ্ৰীবীরেশ্বর সেন দাণ এবং দদাই একই শব্দ-স্থানবিশেষে ভিন্নরূপে উচ্চারিত হয়, কিন্তু বাঙ্গলা দেশে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে দাদা বলে আর আসামে এবং উড়িষ্যায় জ্যেষ্ঠতাতকে অর্থাৎ পিতার জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে দদাই বলে । সেইরূপ, বাঙ্গলায় পিতার কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে কাক বলে কিন্তু আসামে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে ককাই বলে। বাঙ্গলায় তাম্বুলের অর্থ পান কিন্তু আসামে তামূল অর্থাৎ তাম্বুল বলে সুপারিকে। বাঙ্গলায় নিকটবর্তী স্থান বা বস্তু সম্বন্ধে এখানে, ইহা, এটা, এই প্রভৃতি শব্দ এবং দূরবর্তী স্থান সম্বন্ধে ওখানে, উই, ওট, ঐ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয় কিন্তু শ্রীহট্টে নিকটবর্তী স্থান সম্বন্ধে ওখানে, উহ, ওট, ঐ এবং দূরবত্তী স্থান সম্বন্ধে এট, ইহা, এই প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়। গ্ৰহট্টে বাক্সকে বলে আলমারি এবং মাংসের ব্যঞ্জনকে বলে মোরোকব । বিহারের শাহাবাদ জেলায় মাংসকে বলে কালিয়া । আরও আশ্চৰ্য্য এই যে মলায়ালম্ ভাষায় মুখকে চোক্‌ এবং চক্ষুকে বলে মুখ, কানকে বলে নাক এবং নাককে বলে কান। রহস্তপ্রিয় বাঙ্গালীরা কৌতুক করিয়া বলিয় থাকেন যে যে-সকল প্রদেশে বাজলায় প্রচলিত অর্থের বিপরীত অর্থে কোনও কোনও শব্দের প্রয়োগ হয় সে দেশে পূৰ্ব্বে কোনও ভাষাই ছিল না এবং সেই সকল প্রদেশ হইতে কয়েকটি লোক ভাষা শিক্ষা করিতে গিয়া স্ব স্ব প্রদেশে ফিরিয়া যাইতে ঘাইতে অনেক শব্দের অর্থ তুলিয়া গিয়া তাহার বিপরীত অর্থ করিয়া স্বদেশবাসীকে ভুল শিক্ষা দিবার ফলে এইরূপ হইয়াছে । কিন্তু শিক্ষিত বাঙ্গালীর কিঞ্চিং চিন্তা করিলে দেখিতে পাইবেন যে বাঙ্গালীরা যেমন বিপরীত এবং ভিন্ন অর্থে বহু শব্দ ব্যবহার করেন তেমন আর কোনও দেশের লোকই করেন না। আমরা রাগ বলি ক্রোধকে, কিন্তু রাগ শব্দের প্রকৃত অর্থ অতুরাগ বা ভালবাসা যাহা ক্রোধের সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা সংবাদ বলিলে বুঝি সমাচার, বার্তা, খবর, কিন্তু সংবাদ শব্দের প্রকৃত অর্থ কথোপকথন । পূৰ্ব্বে বাঙ্গলা দেশেও কথোপকথন অর্থে এই শব্দটি প্রযুক্ত হইত। পঞ্জিকার হরপাৰ্ব্বতীসংবাদ অনেকেই দেখিয়াছেন । উহার অর্থ হর ও পাৰ্ব্বতীর মধ্যে যে কথোপকথন হইয়াছিল। গীতাকে কৃষ্ণাৰ্জ্জুনসবাদ বলে । ইহা গীতাতেই একাধিক বার উল্লিখিত আছে এবং ইহার অর্থ কৃষ্ণ ও অর্জুনের মধ্যে যে কথোপকথন হইয়াছিল। আমরা শু্যালককে সম্বন্ধী বলি, কিন্তু বাঙ্গলার বাহিরে সম্বন্ধী বলে পুত্র বা কন্যার শ্বশুরকে অর্থাৎ আমরা যাহাকে বৈবাহিক বলি। সন্ধুত উত্তরচরিত নাটকেও দশরথ এবং জনক পরস্পর সম্বন্ধী ছিলেন বলিয়া উক্ত আছে। আমরা ঘৰ্ম্ম এবং তাহার অপভ্রংশ ঘাম বলি স্বেদকে । কিন্তু ঘৰ্ম্ম শব্দে সংস্কৃতে উত্তাপ বুঝায়। হিন্দুস্থানে চলিত ভাষার অপভ্রংশে ঘাম বলিতেও উত্তাপ বা গরমই বুঝায়। হিন্দুস্থানীর “বড় ঘাম হায়” বলিলে বাঙ্গালীরা যেন এইরূপ না বোঝেন যে স্বেদের কথা বলা হইতেছে । সংস্কৃত ঘৰ্ম্ম শব্দের সদৃশ গ্ৰীক থেৰ্ম্মস্, ইংরেজী ওয়াম, ফাসী উৰ্দ্দ, বাঙ্গল গরম শব। আমার বোধ হয় কালিদাস মেঘদূতের ১৬২ শ্লোকে স্বেদ অর্থেই ঘৰ্ম্ম শব চালাইতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন । শ্লোকটার ব্যাখ্যা এই :–কৈলাসশিখবে স্বরযুবতীগণ একখও মেঘ ধরিয়া তাহাতে র্তাহাদের নিজের বলয়ের হীরকাংশ দিয়া ঠুকিয়া ঠুকিয়া জল বাহির করিতেছিল। সেই ঘৰ্ম্মলন্ধ মেঘকে যদি তাহারা ছাড়িয়া দিতে অনিচ্ছুক হয় তাহ হইলে মেঘ যেন গর্জন করিয়া তাহাদিগকে ভয় দেখায়। টীকাকারের সকলেই এখানে ঘৰ্ম্ম শব্দের অর্থ গরম বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন । তথাপি আমার বোধ হয় যে সেই শ্লোকে স্বেদ বুঝিলে অর্থটা ভাল হয়। হিমালয়শিখরে উত্তাপ হওয়ার সম্ভাবনা বোধ হয় নাই, অন্য পক্ষে মাথার ঘাম অর্থাং স্বেদ পায়ে