সত্তর বৎসর কলিকাতা ছাত্রাবাসে ( ১৮৫৭-১৯২৭ ) স্ত্র বিপিনচন্দ্র পাল কলিকাতার পথে আমি যখন প্রথম কলিকাতায় আসি, কহিয়াছি তখন পদ্মার ওপারে রেল বসা দূরে থাকুক তাহার কল্পনাও হয় নাই। চায়ের কারবারের শ্ৰীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ যাতায়াত করিতে আরম্ভ করিয়াছে। জাহাজেই ইংরেজ কোম্পানীদের মাল আমদানী ও রপ্তানী হইত। জাহাজেই বেহার অঞ্চল ও সাঁওতাল পরগণা হইতে চা-বাগানের কুলীও চালান হইত। এই জাহাজেই আমি প্রথমে শ্ৰীহট্ট হইতে গোয়ালনা আসি । ঢাকায় ও নারায়ণগঞ্জে জাহাজ বদলী হইত। কলিকাতার যাত্রীরা ঢাকায় ব৷ নারায়ণগঞ্জে গোয়ালদের জাহাজে চাপিতেন। এখন গোয়ালন্দ হইতে ৬৭ ঘণ্টায় নারায়ণগঞ্জে যাওয়া যায়। পঞ্চাশ বৎসর পূৰ্ব্বে এক দিনেও যাওয় যাইত না। এখন জাহাজ দিন রাত চলিতে পারে। সেকালে বিজলীর আলো আবিষ্কৃত হয় নাই। সন্ধ্যার পরে জাহাজ চালান সম্ভব ছিল না। এইজন্য ঢাকা হইতে গোয়ালনের পথে যাত্ৰাদিগকে এক রাত্রি জাহাজেই কাটাইতে হইত। শ্ৰীহট্ট হইতে নারায়ণগঞ্জ আসিতে পাচ দিনের কম নয়, কখনো কখনো ৭৮ দিন লাগিত। মাল বোঝাই করবার জন্য সে-সকল জাহাজ বড় বড় বন্দরে কখনো কখনো দুই দিন, এবং সৰ্ব্বদাই অন্তত:একদিন আটকিয় থাকিত । কাজেই শ্ৰীহট্ট হইতে নারায়ণগঞ্জে পৌছিতে ৭৮ দিন লাগিত। এই ৭৮ দিন চিড়া চিবাইয়া কাটানে। আমার মত লোকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। গ্ৰহট্টে থাকিতেই আমার খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে প্রচলিত হিন্দুয়ানীর বন্ধন একেবারে টুটিয়া গিয়াছিল। শ্রীহট্রেই মুসলমানের রুট বিস্কুট খাইতে আরম্ভ করি, পূৰ্ব্বেই ইহা কহিয়াছি। মুসলমানের ভাত থাইতেও নিজের ভিতরে কোন সঙ্কোচ ছিল না। তবে আমার প্রথম জাহাজ যাত্রায় জাতের বাধন একেবারে নষ্ট করিতে হয় নাই । সে জাহাজে একজন বাঙ্গালী ভদ্রলোক কেরাণী ছিলেন—বাবু হরমোহন চট্টোপাধ্যায়। জাহাজের পেছনে যে জালিবোট বাবা থাকিত তাহাতেই র্তার রান্না হইত। আমরা তাহার উপরে ভাগ বসাইতাম । এইরূপে কায়ক্লেশে ভাঙ্গ জাতের যতটুকু ছিল তাহ। বঁাচাইয়া নারায়ণগঞ্জে পৌছিলাম । নারায়ণগঞ্জ-পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে আমি প্রথমে যে-নারায়ণগঞ্জ সেথিয়ছিলাম সেনারায়ণগঞ্জ আজ আর নাই। সে নারায়ণগঞ্জ ছিল একটা গ্রাম ও বাজার। আজিকার নারায়ণগঞ্জ হইয়াছে একটা বড় বন্দর ও সহর। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে তখনও রেল হয় নাই। পাটের গুদাম দুই একটা হইয়াছে। বোধ হয় রালীব্রাদাসের আফিস বসিয়াছে, আর ছাতকের ইংলিশ কোম্পানীরও একটা বড় আফিস ছিল। নারায়ণগঞ্জে তখন হোটেল ছিল না । কতকগুলি আখড়া ছিল। এইসকল আখড়াতেই যাত্রীরা আশ্রয় ও আহার পাইত। এজন্য যথাসম্ভব প্রণামী দিতে হইত। এই প্রণামীর উপরে প্রসাদের গুণাগুণ নির্ভর করিত। সামান্য প্রণামী দিলে সাধারণ ডাল ভাত মিলিত ; বেশী প্রণামী দিলে উৎকৃষ্ট আতপান্ন, গব্যস্তৃত, দৈ, সর, দুধ এবং মিষ্টান্ন মিলিত । আখড়ার নাট-মন্দিরে গুইবার স্থান মিলিত । নারায়ণগঞ্জে নামিয়া এইরূপ একটা আখড়াতেই আতিথ্য গ্রহণ করি। ঢাকা-গোয়ালদের জাহাজ ঢাকা হইতে গোয়ালনে তখন দুইখানা জাহাজ চলাচল করিত। যতদূর মনে পড়ে বোধ হয় সপ্তাহে দুবার ঢাকা
পাতা:প্রবাসী (সপ্তবিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৯০১
অবয়ব