পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুর্গেশনন্দিনী দ্বার স্পর্শ করিল। বিমলা চমকিত হইয়। মুখ ফিরাইয়া দেখিলেন, এক জন সশস্ত্র অজ্ঞাত পুরুষ দণ্ডায়মান রহিয়াছে । বিমল চিত্রাপিতপুত্তলিকাবৎ নিম্পন হইলেন । শস্ত্রধারী কহিল, চীৎকার কারও না । সুন্দরীর মুখে চীৎকার ভাল শুনায় না।” ষে ব্যক্তি অকস্মাৎ এইরূপ বিমলাকে বিহবল করিল, তাহার পরিচ্ছদ পাঠান-জাতীয় সৈনিকপুরুষদিগের স্তায় । পরিচ্ছদের পারিপাট্য ও মহার্ঘ্য গুণ দেখিয়া অনায়াসে প্রতীতি হইতে পারিভ, এ ব্যক্তি কোন মহৎপদাভিষিক্ত । অদ্যাপি তাহার বয়স ত্রিংশতের অধিক হয় নাই । কান্তি সাতিশয় শ্ৰীমান, তাহার প্রশস্ত ললাটোপরি ষে উষ্ণৗষ সংস্থাপিত ছিল, তাহাতে এক খণ্ড মহার্ঘ্য হীরক শোভিত ছিল । বিমলার যদি তৎক্ষণে মনের স্থিরতা থাকিত, তবে বুঝিতে পারিতেন যে, জগৎসিংহের তুলনায় এ ব্যক্তি নিতান্ত নুনি হইবে না, জগৎসিংহের সদৃশ দীর্ঘায়ত বা বিশালেীরস্ক নহেন, কিন্তু তৎসদৃশ বীরত্বব্যঞ্জক স্বন্দর কাস্তি, তদধিক স্বকুমার দেহ । তাহার বহুমূল্য কটিবন্ধে প্রবালজড়িত কোষমধ্যে দামাস্ক ছুরিকা ছিল, হস্তে নিস্কোষিত ভরবার । অন্য প্রহরণ ছিল না । সৈনিকপুরুষ করিলেন, “চীৎকার করিও না । চীৎকার করিলে তোমার বিপদ ঘটিৰে ।” প্রত্যুৎপন্নবুদ্ধিশালিনী বিমলা ক্ষণকালমাত্র বিহবলা ছিলেন, শস্ত্রধারীর দ্বিরুক্তিতে র্তাহার অভিপ্রায় বুঝিতে পারিলেন । বিমলার পশ্চাতেই ছাদের শেষ, সম্মুখেই সশস্ত্র যোদ্ধা, ছাদ হইতে বিমলাকে নীচে ফেলিয়া দেওয়াও কঠিন নহে। বুঝিয়া সুবুদ্ধি বিমলা কহিলেন, “কে তুমি ?” সৈনিক কহিলেন, “আমার পরিচয়ে তোমার কি হইবে ?” বিমলা কহিলেন, “তুমি কি জন্য এ দুর্গমধ্যে আসিয়াছ ? চোরেরা শূলে যায়, তুমি কি শোন माझे ?” সৈনিক । মুনরি । আমি চোর নই। বি । তুমি কি প্রকারে দুর্গমধ্যে আসিলে ? সৈ। তোমারই অনুকম্পায় । তুমি যখন জানাল খুলিয়া রাখিয়াছিলে, তখন প্রবেশ করিয়াছিলাম, তোমারই পশ্চাৎ পশ্চাৎ এ ছাদে আসিয়াছি । বিমল কপালে করাঘাত করিলেন । পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে ?” সৈনিক কহিলেন, “তোমার নিকট এক্ষণে পরিচয় দিলেই বা হানি কি ? আমি পাঠান ।” €') বি । এ ত পরিচয় হইল না, জানিলাম যে, জাতিতে পাঠান ;-কে তুমি ? সৈ। ঈশ্বরেচ্ছায় এ দীনের নাম—ওসমান খা । বি । ওসমান খাঁ কে, আমি চিনি না । সৈ। ওসমান খাঁ, কতলু খার সেনাপতি । বিমলার শরীর কম্পান্বিত হইতে লাগিল ৷ ইচ্ছা, কোনরূপে পলায়ন করিয়া বীরেন্দ্রসিংকে সংবাদ করেন ; কিন্তু তাহার কিছুমাত্র উপায় ছিল না। সম্মুখে সেনাপতি গতিরোধ করিয়া দণ্ডায়মান ছিলেন। অনন্তগতি হইয়া বিমলা এই বিবেচনা করিলেন যে, এক্ষণে সেনাপতিকে যতক্ষণ কথাবার্তায় নিযুক্ত রাখিতে পারেন, ততক্ষণ অবকাশ। পশ্চাৎ দুর্গ প্রাসাদস্থ কোন প্রহরী সে দিকে অসিলেও আসিতে পারে, অতএব পুনরপি কথোপকথন আরম্ভ করিলেন, “আপনি কেন এ দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন ? ওসমান খ৷ উত্তর করিলেন, “আমরা বীরেন্দ্র সিংহকে অনুনয় করিয়া দূত প্রেরণ করিয়াছিলাম । প্রত্যুত্তরে তিনি কহিয়াছেন যে, তোমরা পার, সসৈন্তে দুর্গে অসিও ” বিমল কহিলেন, “বুঝিলাম, দুর্গাধিপতি আপনাদিগের সহিত মৈত্র না করিয়া মোগলের পক্ষ হইয়াছেন বলিয়া, আপনি দুর্গ অধিকার করিতে আসিয়াছেন, কিন্তু আপনি একক দেখিতেছি ?” ওস্। আপাততঃ আমি একক । বিমলা কহিলেন, “সেই জন্তই বোধ করি শঙ্কাপ্রযুক্ত আমাকে যাইতে দিতেছেন না।” ভীরুত অপবাদে পাঠান-সেনাপতি বিরক্ত হইয়া, তাহার গতি মুক্ত করিয়া সাহস প্রকাশ করিলেও করিতে পারেন, এই চুরাশাতেই বিমলা এই কথা বলিলেন । ওসমান খ ঈষৎ হাস্ত করিয়া কহিলেন, “সুন্দরি । তোমার নিকট কেবল তোমার কটাক্ষকে শঙ্কা করিতে হয় ; আমার সে শঙ্কাও বড় নাই । তোমার নিকট ভিক্ষা আছে ।” বিমলা কৌতুহলিনী হইয়া ওসমান খার মুখপানে চাহিয়া রহিলেন । ওসমান খাঁ কহিলেন, “তোমার ওড়নার অঞ্চলে যে জানালার চাবি আছে, তাহা আমাকে দান করিয়া বাধিত কর, তোমার অঙ্গস্পর্শ করিয়া অবমাননা করিতে সঙ্কোচ করি ” গবাক্ষের চাবি যে সেনাপতির অভীষ্টসিদ্ধিপক্ষে নিতাস্ত প্রয়োজনীয়, তাহা বুঝিতে বিমলার দ্যায় চতুরার অধিককাল অপেক্ষা করে না ; বুঝিতে পারিয়া বিমলা দেখিলেন, ইহার উপায় নাই । ষে