পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিষবৃক্ষ ও সভ্যনিষ্ঠ ছিল। কিন্তু সেই পরিণয় তাহার কাল হইল । যখন দেবেন্দ্র উপযুক্ত বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেন, তখন দেখিলেন যে, ভার্ষ্যার গুণে গৃহে তাহার কোনও মুখেরই আশা নাই। বয়োগুণে র্তাহার রূপতৃষ্ণ জন্মিল, কিন্তু আত্মগৃহে তাহা ত নিবারণ হইল না । বয়োগুণে দম্পতিপ্রণয়কাজক্ষ জন্মিল-কিন্তু অপ্রিয় বাদিনী হৈমবতীকে দেখিব৷মাত্র সে আকাজক্ষ দূর হইত। সুখ দূরে থাকুক-দেবেন্দ্ৰ দেখিলেন যে, হৈমবতীর রসনাবর্ষিত বিষের জালায় গৃহে তিষ্ঠান ভার। এক দিন হৈমবভী দেবেন্দ্রকে এক কদৰ্য্য কটুবাক্য কহিল ; দেবেন্দ্র অনেক সচিয়াছিলেন— আর সহিলেন না। হৈমবতীর কেশাকর্ষণ করিয়া তাহাকে পদাঘাত করিলেন এবং সেই দিন হইতে গৃহত্যাগ করিয়া, পুষ্পোদ্যানমধ্যে র্তাহার বাসেীপযোগী গৃহ-প্রস্তুতের অনুমতি দিয়া কলিকাতায় গেলেন : ইতিপূৰ্ব্বেই দেবেন্দ্রের পিতার পরলোক গমন হইয়ছিল ; সুতরাং দেবেন্দ্র এক্ষণে স্বাধীন । কলিকাতায় পাপপঙ্কে নিমগ্ন কইয়। দেবেন্দ্র আতুগু বিলাসভৃষ্ণ নিধারণে প্রবৃত্ত হইলেন । তজ্জনিত যে কিছু স্বচিত্তের অপ্রসাদ জন্মিত, তাত ভরি ভূরি মুরাভিষিঞ্চনে ধেী ত করতে যত্ন করিতে লাগিলেন । পরিশেষে তাহার আর আবশ্যকতা রকিল না—পাপেই চিত্তের প্রসাদ জন্মিতে লাগিল । কিছুকাল পরে বাবুগরিতে বিলক্ষণ সুশিক্ষিত শুষ্টয় দেবেন্দ্র দেশে ফিরিয়া আসিলেন এবং তথায় নূতন উপবনগৃহে আপন আবাস সংস্থাপন করিয়া বাবুগিরিতে প্রবৃত্ত হইলেন । কলিকাভ হইতে দেবেন্দ্র অনেক প্রকার ঢং শিখিয়া আসিয়াছিলেন । তিনি দেবীপুরে প্রত্যাগমন করিয়া রিফর্মর বলিয়া আত্মপরিচয় দিলেন । প্রথমেই এক ব্রাহ্মসমাজ সংস্থাপিত করিলেন । তারাচরণ প্রভৃতি অনেক ব্রাহ্ম জুটিল, বল্পতার আর সীমা রহিল না। একটা ফিমেল-স্কুলের জন্যও মধ্যে মধ্যে আড়ম্বর করিতে লাগিলেন, কিন্তু কাজে বড় বেশী করিতে পারিলেন না । বিধবা বিবাহের বড় উৎসাহ । এমন কি, দুই চারিট কাওরা ও তিওরের বিধবা মেয়ের বিবাহ দিয়া ফেলিয়াছিলেন, কিন্তু সে বরকস্তার গুণে । জেনানারূপ কারাগারের শিকল-ভাঙ্গার বিষমৃ ভারাচরণের সঙ্গে তাহার একমত। উভয়েই বলিতেন, মেয়েদের বাহির কর । এ বিষয়ে দেবেন্দ্র বাৰু বিশেষ কৃতকাৰ্য্য হইয়াছিলেন–কিন্তু সে বাহির করার অর্থবিশেষে । দেবেন্ধ গোবিন্দপুর হইতে প্রত্যাগমনের পর বৈঞ্চবীৰেশ ত্যাগ করিয়৷ নিজমুক্তি ধারণ পূৰ্ব্বক ኌጓ ̊ পাশের কামরায় আসিয়া বসিলেন । এক জন ভৃত্য শ্রমহারী তামাকু প্রস্তুত করিয়া আলবোলা আনিয়া । সম্মুখে দিল ; দেবেন্দ্র কিছুকাল সেই সৰ্ব্বশ্রমসংহরিণী । তামাকুদেবীর সেবা করিলেন । যে এই মহাদেবীর প্রসাদ-সুখভোগ না করিয়াছে, সে মমুম্বাই নহে । হে সৰ্ব্বলোকচিত্তরঞ্জিনি বিশ্ববিমোহিনি ! তোমাতে যেন আমাদের ভক্তি অচলা থাকে । তোমার বাহন । আলবোলা, ছক্কা, গুড়গুড়ি প্রভৃতি দেবকস্তারা সৰ্ব্বদাই যেন আমাদের নয়নপথে বিরাজ করেন, দৃষ্টিমাত্রেই মোক্ষলাভ করিব । হে হু ক্কে ! হে আলবোলে ! হে কুণ্ডলাক্কভধুমরাশিসমুদ্রগরিণি ! হে ফণিনীনিন্দিত-দীঘললসংসপিণি ! হে রজতকিরীটমণ্ডিতশিরোদেশসুশোভিনি ! কি বা তোমার কিরীটবিস্রস্ত ঝালর ঝলমলায়মান । কি বা শৃঙ্খলাঙ্গুরীয়সস্তুষিতবঙ্কাগ্রভাগ মুখনলের শোভ ! কি বা তোমার গর্ভস্থ শীতলাম্বুরাশির গভীর নিনাদ ! হে বিশ্বরমে ! তুমি বিশ্বজনশমহারিণী, অপসজন-প্রতিপালিনী, ভাৰ্য্যাভৎসি তচ্চনচিত্তবিকীরবিনাশিনি ! প্রভুভীতজনসাহস প্রদায়িনি ! মূঢ়ে তোমার মহিমা কি জানিবে ! তুমি শোকপ্রাপ্ত জনকে প্রবোধ দাও, ভয়প্রাপ্ত জনকে ভরস। দাও, বুদ্ধিলষ্ট জনকে বুদ্ধি দাও, কোপযুক্ত জনকে শাস্তি প্রদান কর । হে বরদে ! হে সৰ্ব্বস্থখপ্রদায়িনি! তুমি যেন আমার ঘরে অক্ষয় হইয়া বিরাজ কর । তোমার সুগন্ধ দিনে দিনে বাভুক । তোমার গর্ভস্থ জলকল্লোল মেঘগর্জনবৎ ধ্বনিত হইতে থাকুক। তোমার মুখনলের সহিত আমার অধরেীষ্ঠের মেন তিলেক বিচ্ছেদ না হয় । ভোগাসক্ত দেবেন্দ্র যথেচ্ছ এক্ট মহাদেবীর প্রসাদ ভোগ করিলেন--কিন্তু তাহাতে পরিতৃপ্তি জন্মিল না । পরে অঙ্গ মহাশক্তির অর্চনার উদ্যোগ হইল । তখন ভৃত্যহস্তে তৃণপটাবৃত বোতলবাহিনীর আবির্ভাব হইল। ও খন সেই অমল শ্বেত সুবিস্তৃত শয্যার উপরে, রজতানুকুতাসনে সান্ধ্যগগনশোভি রক্তযুদ্রতুল্য বর্ণবিশিষ্ট দ্রবময়ী মহাদেবী, ডেকান্টর নামে আস্বরিক ঘটে সংস্থাপিত হইলেন । কটু গ্লাসের কোষ পড়িল ; প্লেটেড জগ তাম্রকুণ্ড হইল এবং পাকশালা হইতে এক কৃষ্ণকুর্চ পুরোহিত হট ওয়াটার প্লেট নামক দিব্য পুষ্পপাত্রে রোষ্ট মটন এবং কাট্‌লেট নামক স্বগন্ধ কুসুমরাশি রাখিয় গেল। তখন দেবেন্দ্র দস্তু যথাশাস্ত্র, ভক্তিভাবে দেবীর পূজা করিতে বসিলেন । পরে তানপুর, তবলা, সেভার প্রভৃতি সমেত গায়ক-বাদকদল আসিল । তাহারা পূজার প্রয়োজনীয় সঙ্গীতোৎসব সম্পন্ন করিয়া গেল ।

  • ...,"