পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৩৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বঙ্কিম রচনাবলী পরে ভাদের কিস্তি আসিল। পরাণের কিছ নাই, দিতে পারিল না। পাইক, পিয়াদা, নগদী, হালশাহানা, কোটাল বা তদ্রুপ কোন নামধারী মহাত্মা তাগাদায় আসিলেন। হয় ত কিছ করিতে না পারিয়া, ভাল মানষের মত ফিরিয়া গেলেন। নয় তা পরাণ কাজ করিয়া টাকা দিল। নয় তা পরাণের দািবদ্ধি ঘটিল-সে পিয়াদার সঙ্গে বাচসা করিল। পিয়াদা ফিরিয়া গিয়া গোমস্তাকে বলিল, “পরাণ মন্ডল আপনাকে শালা বলিয়াছে।” তখন পরাণকে ধরিতে তিন জন পিয়াদা ছটিল। তাহারা পরাণকে মাটিছাড়া করিয়া লইয়া আসিল। কাছারিতে আসিয়াই পরাণ কিছ সসভ্য গালিগালাজ শনিল-শরীরেও কিছ উত্তম মধ্যম ধারণা করিল। গোমস্তা তাহার পাঁচ গণ জরিমানা করিলেন। তাহার উপর পিয়াদার রোজ। পিয়াদাদিগের প্রতি হাকুম হইল, উহাকে বসাইয়া রাখিয়া আদায় করা। যদি পরাণের কেহ হিতৈষী থাকে, তবে টাকা দিয়া খালাস করিয়া আনিল। নচেৎ পরাণ এক দিন, দই দিন, তিন দিন, পাঁচ দিন, সাত দিন কাছারিতে রহিল। হয় তা পরাণের মা কিবা ভাই থানায় গিয়া এজেহার করিল। সব ইনস্পেক্টর মহাশয় কয়েদ খালাসের জন্য কনস্টেবল পাঠাইলেন। কনভেন্টবল সাহেব-দিন দানিয়ার মালিক-কাছারিতে আসিয়া জাকিয়া বসিলেন। পরাণ তাঁহার কাছেই বসিয়া-একটা কিন্তু খালাসের” কোন কথা নাই। তিনিই জমীদারের বেতনভুক-বৎসরে দই তিন বার পাকবাণী পান, বড় উড়িবার বল নাই। সে দিনও সব্বাসখময় পরমপবিত্রমাত্তি রৌপ্যচক্রের দর্শন পাইলেন। এই আশ্চৰ্য্য চক্ৰ দন্টিমাত্রেই মনষ্যের হৃদয়ে আনন্দরসের সঞ্চার হয়-ভক্তি প্রীতির না। পরাণ মণ্ডল ফেরেব্বাজ লোক—সে পরিকুর-ধারে তালতলায় লাকাইয়াছিল-আমি ডাক দিবা মাত্র সেইখান হইতে আসিয়া আমাকে দেখা দিল ।” মোকদ্দমা ফাঁসিয়া গেল। প্ৰজা ধরিয়া লইয়া গিয়া, কাছারিতে আটক রাখা, মারপিট করা, জরিমানা করা, কেবল খাজানা বাকির জন্য হয়, এমত নহে। যে সে কারণে হয়। আজি গোপাল মন্ডল গোমস্তা মহাশয়কে কিঞ্চিৎ প্ৰণামী দিয়া নালিশ করিয়াছে যে, “পরাণ আমাকে লইয়া খায় না”-তখনই পরাণ ধতি হইয়া আসিল। আজি নেপাল মন্ডল ঐরাপ মঙ্গলাচরণ করিয়া নালিশ করিল যে, “পরাণ আমার ভগিনীর সঙ্গে প্রসক্তি করিয়াছে’-অমনি পরাণ গ্রেপ্তার হইয়া আবদ্ধ হইল। আজি সম্পবাদ আসিল, পরাণের বিধবা ভ্ৰাতৃবধ, গভর্ণবতী হইয়াছে—আমনি পরাণকে ধরিতে লোক ছাঢ়িল। গোমস্তা মহাশয়, পরাণের কাছে টাকা আদায় করিয়াই হউক বা জামিন লইয়াই হউক বা কিস্তিবন্দী করিয়াই হউক বা সময়ান্তরে বিহিত করিবার আশায়ই হউক, পানববার পলিশ আসার আশঙ্কায়ই হউক বা বহকাল আবদ্ধ রাখায় কোন ফল নাই বলিয়াই হউক, পরাণ মন্ডলকে ছাড়িয়া দিলেন। পরাণ ঘরে গিয়া চাষ আবাদে প্রবত্ত হইল। উত্তম ফসল জন্মিল। অগ্রহায়ণ মাসে জমীদারের দৌহিত্রীর বিবাহ বা ভ্ৰাতুলপত্রের অন্নপ্রাশন। বরাদ্দ দই হাজার টাকা, মহালে মাঙ্গন চড়িল। সকল প্রজা টাকার উপর ॥০ দিবে। তাহাতে পাঁচ হাজার টাকা উঠিবে, দই হাজার অন্নপ্রাশনের খরচ লাগিবে-তিন হাজার জমীদারের সিন্দাকে উঠিবে। যে প্রজা পারিল, সে দিলা-পরাণ মন্ডলের আর কিছই নাই-সে দিতে পারিল না। জমিদারী হইতে পােরা পাঁচ হাজার টাকা আদায় হইল না। শনিয়া জমীদার স্থির করিলেন, একবার স্বয়ং মহালে পদাপণ করবেন। তাঁহার আগমন হইল-গ্রাম পবিত্র হইল। তখন বড় বড় কালো কালো পাঁটা আনিয়া, মন্ডলেরা কাছারির দ্বারে বধিয়া যাইতে লাগিল। বড় বড় জীবন্ত রাই, কাতলা, মাগাল, উঠানে পড়িয়া ল্যাজ আছড়াইতে লাগিল। বড বড় কালো কালো বাৰ্ত্তাকু, গোল আল, কপি, কলাইসটিতে ঘর পরিয়া যাইতে লাগিল। দধি দগ্ধ ঘাত নবনীতের ত কথা নাই। প্রজাদিগের ভক্তি অচলা, কিন্তু বাবর উদর তেমন নহে। বাবর কথা দরে থাকুক, পাইক-পিয়াদার পর্যন্ত উদরাময়ের লক্ষণ দেখা যাইতে লাগিল। কিন্তু সে সকল ত বাজে কথা। আসল কথা, জমীদারকে “আগমনী,” “নজর” বা “সেলামি” দিতে হইবে। আবার টাকার অঙ্কে ১০ বসিল। কিন্তু সকলে এত পারে না। যে পারিল, সে দিল। যে পারিল না, সে কাছারিতে কয়েদ হইল, অথবা তাহার দেনা বাকির সামিল হইল। S8