পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৪০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিবিধ প্ৰবন্ধ-বাহবিল ও বাক্যৰল শক্তি থাকিলেই, তাহার প্রয়োগ বিহিত হইতে পারে এবং অবিহিত হইতে পারে। যে পরিমাণে শক্তির প্রয়োগ হইলে উদ্দেশ্যটি সিদ্ধ হইবে, অথচ কাহারও কোন আনিস্ট হইবে না, তাহাই বিহিত প্রয়োগ। তাহার অতিরিক্ত প্রয়োগ অবিহিত প্রয়োগ। বারদের যে শক্তি, তাহার বিহিত প্রয়োগে শত্রবধ হয়, অবিহিত প্রয়োগে কামান ফাটিয়া যায়। শক্তির এই অতিরিক্ত প্রয়োগই অত্যাচার । মনােষ্য শক্তির আধার। সমাজ মনষ্যের সমবায়, সতরাং সমাজও শক্তির আধার। সে শক্তির বিহিত প্রয়োগে মনষ্যের মঙ্গল—দৈনন্দিন সামাজিক উন্নতি। অবিহিত প্রয়োগে সামাজিক দঃখ। সামাজিক শক্তির সেই অবিহিত প্রয়োগ, সামাজিক অত্যাচার। কথাটি এখনও পরিস্কার হয় নাই। সামাজিক অত্যাচার ত বাবা গেল, কিন্তু কে অত্যাচার করে ? কাহার উপর অত্যাচার হয় ? সমাজ মনষ্যের সমবায়। এই সমবেত মনষ্যগণ কি আপনাদিগেরই উপর অত্যাচার করে ? অথবা পরস্পরের রক্ষার্থে যাহারা সমাজবদ্ধ হইয়াছে, তাহারাই পরস্পরে উৎপীড়ন করে ? তাই বটে, অথচ, ঠিক তাই নহে। মনে রাখিতে হইবে, যে, শক্তিরই অত্যাচার; যাহার হাতে সামাজিক শক্তি, সেই অত্যাচার করে। যেমন গ্ৰহাদি জড়পিন্ডমাত্রের মাধ্যাকর্ষণশক্তি কেন্দ্রনিহিত, তেমনি সমাজেরও একটি প্রধান শক্তি, কেন্দ্রনিহিত। সেই শক্তি-শাসনশক্তি ; সামাজিক কেন্দ্র-রাজা বা সামাজিক শাসনকর্তৃগণ । সমাজরক্ষার জন্য, সমাজের শাসন আবশ্যক। সকলেই শাসনকৰ্ত্তা হইলে, অনিয়ম এবং মতভেদ হেতু শাসন অসম্ভব। অতএব শাসনের ভার, সকল সমাজেই এক বা ততোধিক ব্যক্তির উপর নিহিত হইয়াছে। তাঁহারই সমাজের শাসনশক্তিধর—সামাজিক কেন্দ্র। তাঁহারাই অত্যাচারী। তাঁহারা মনষ্য; মনষ্যেমাত্রেরই ভ্ৰান্তি এবং আত্মােদর আছে। ভ্ৰান্ত হইয়া তাঁহারা সেই সমাজপ্রদত্ত শাসনশক্তি, শাসিতব্যের উপরে অবিহিত প্রয়োগ করেন। আত্মাদরের বশীভুত হইয়াও তাঁহারা উহার অবিহিত প্রয়োগ করেন। তবে এক সম্প্রদায় সামাজিক অত্যাচারকে পাইলাম। তাঁহারা রাজপরিষ-অত্যাচারের পাত্র সমাজের অবশিস্টাংশ। কিন্তু বাস্তবিক এই সম্প্রদায়ের অত্যাচারী কেবল রাজা বা রাজপরিষ নহে। যিনিই সমাজের শাসনকৰ্ত্তা, তিনিই এই সম্প্রদায়ের অত্যাচারী। প্রাচীন ভারতবষের ব্ৰাহ্মণগণ, রাজপরিষ বলিয়া গণ্য হয়েন না, অথচ তাঁহারা সমাজের শাসনকৰ্ত্তা ছিলেন। আৰ্যসমাজকে তাঁহারা যে দিকে ফিরাইতেন ঘরাইতেন, আৰ্যসমাজ সেই দিকে ফিরিত ঘরিত। আৰ্যসমাজকে তাঁহারা যে শিকল পরাইতেন, অলঙ্কার বলিয়া আৰ্য্যসমাজ সেই শিকল পরিত। মধ্যকালিক ইউরোপের ধৰ্ম্মযাজকগণ সেইরােপ ছিলেন-রাজপরিষ নহেন, অথচ ইউরোপীয় সমাজের শাসনকৰ্ত্তা, এবং ঘোরতর অত্যাচারী। পোপগণ ইউরোপের রাজা ছিলেন না, এক বিন্দ ভূমির রাজা মাত্র, কিন্তু তাঁহারা সমগ্র ইউরোপের উপর ঘোরতর অত্যাচার করিয়া গিয়াছেন। গ্রেগরি বা ইনোসেণ্ট, লিও বা আদ্রিয়ান ইউরোপে যতটা অত্যাচার করিয়া গিয়াছেন, দ্বিতীয় ফিলিপ বা চতুৰ্দশ লাই, অস্টম হেনরী বা প্রথম চালােস, ততদার করিতে পারেন নাই। কেবল রাজপরিষ বা ধৰ্ম্মমযাজকের দোষ দিয়া ক্ষান্ত হইব কেন ? ইংলন্ডে এক্ষণে রাজা (রাজ্ঞী) কোন প্রকার অত্যাচারে ক্ষমতাশালী নহেন-শাসনশক্তি তাঁহার হস্তে নহে। এক্ষণে প্রকৃত শাসনশক্তি ইংলন্ডে সংবাদপত্ৰলেখকদিগের হস্তে। সতরাং ইংলন্ডের সংবাদপত্ৰলেখকগণ অত্যাচারী। যেখানে সামাজিক শক্তি, সেইখানেই সামাজিক অত্যাচার। কিন্তু সমাজের কেবল শাসনকৰ্ত্তা এবং বিধাতৃগণ অত্যাচারী, এমত নহে। অন্য প্রকার সামাজিক অত্যাচারী আছে। যে সকল বিষয়ে রাজ্যশাসন নাই, ধৰ্ম্মম: শাসন নাই, কোন প্রকার শাসনকৰ্ত্তার শাসন নাই-সে সকল বিষয়ে সমাজ কাহার মতে চলে ? অধিকাংশের মতে । যেখানে সমাজের এক মত, সেখানে কোন গোলই নাই- কোন অত্যাচার নাই। কিন্তু এরপ ঐকমত্য অতি বিরল। সচরাচরই মতভেদ ঘটে। মতভেদ ঘটিলে, অধিকাংশের যে মত, অলপাংশকে সেই মতে চলিতে হয়। অল্পাংশ ভিন্নমতাবলম্বী হইলেও, অধিকাংশের মতানসারে কাৰ্য্যকে ঘোরতর দঃখ বিবেচনা করিলেও, তাহাদিগকে অধিকাংশের মতে চলিতে হইবে। নাহিলে অধিকাংশ অলপাংশকে সমাজবহিস্কৃত করিয়া দিবে-বা অন্য সামাজিক দন্ডে পীড়িত করিবে। ইহা ঘোরতর সামাজিক অত্যাচার। ইহা অলপাংশের উপর অধিকাংশের অত্যাচার বলিয়া কথিত হইয়াছে। ○○○