পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৬৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজসিংহ রাখি বাঁধিয়া দিবেন। রাজপতিকুলের যিনি চড়া, তিনি কখনও রাজপত্যকন্যার প্রেরিত রাখি অগ্রাহ্য করবেন না।” মিশ্র ঠাকুর স্বীকৃত হইলেন। রাজকুমারী তাঁহাকে প্ৰণাম করিয়া বিদায় করিলেন। তৃতীয় পরিচ্ছেদ ঃ মিশ্র ঠাকুরের নারায়ণস্মরণ পরিধেয় বস্ত্র, ছত্র, যক্ৰিট, চন্দনকাষ্ঠ প্রভৃতি নিতান্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং একমাত্র ভূত্য সঙ্গে লইয়া, অনন্ত মিশ্র গহিণীর নিকট হইতে বিদায় লইয়া উদয়পাের যাত্রা করিলেন। গহিণী বড় পীড়াপীড়ি করিয়া ধরিল, “কেন। যাইবে ?” মিশ্র ঠাকুর বলিলেন, “রাণার কাছে কিছর বাত্তি পাইব ।” গহিণী তৎক্ষণাৎ শান্ত হইলেন ; বিরহযন্ত্রণা আর তাঁহাকে দাহ করিতে পারিল না, অর্থ লাভের আশাস্বরােপ শীতলবারি-প্রবাহে সে প্রচন্ড বিচ্ছেদবিহ্নি বার কত ফোঁস ফোঁস করিয়া নিবিয়া গেল। মিশ্র ঠাকুর ভূত্য সঙ্গে যাত্রা করিলেন। তিনি মনে করিলে অনেক লোক সঙেগ লাইতে পারিতেন, কিন্তু অধিক লোক থাকিলে কাণাকণি হয়, এজন্য লাইলেন না। পথ অতি দগম—বিশেষ পাব্বিত্য পথ বন্ধাের, এবং অনেক সস্থানে আশ্রয়শন্যে। একাহারী ব্রাহ্মণ যে দিন যেখানে আশ্রয় পাইতেন, সে দিন সেখানে আতিথ্য স্বীকার করিতেন ; দিনমানে পথ অতিবাহন করতেন। পথে কিছ দস্যুভয় ছিল—ব্রাহ্মণের নিকট রত্নবলয় আছে বলিয়া ব্ৰাহ্মণ কদাপি একাকী পথ চলিতেন না। সঙগী জটিলে চলিতেন। সঙগী ছাড়া হইলেই আশ্রয় খজিতেন। একদিন রাত্রে এক দেবালয়ে আতিথ্য স্বীকার করিয়া, পরদিন প্ৰভাতে গমনকালে, তাঁহাকে সঙ্গী খাঁজিতে হইল না। চারি জন বণিক ঐ দেবালয়ের অতিথিশালায় শয়ন করিয়াছিল, প্ৰভাতে উঠিয়া তাহারাও পাকবািতপথে আরোহণ করিল। ব্রাহ্মণকে দেখিয়া উহারা জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কোথা যাইবে ?” ব্ৰাহ্মণ বলিলেন, “আমি উদয়পাের। যাইব ।" বণিকেরা বলিল, “আমরাও উদয়পাব যাইব। ভাল হইয়াছে, একত্রে যাই চলন।” ব্রাহ্মণ আনন্দিত হইয়া তাহাদিগের সঙ্গী হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “উদযাপাের। আর কত দাির ?” বণিকেরা বলিল, “নিকট। অ্যাজ সন্ধ্যার মধ্যে উদয়পাের পৌছিতে পারিব। এ সকল সস্থান রাণার রাজ্য।” এইরুপ কথোপকথন করিতে করিতে তাহারা চলিতেছিল। পাণবত্য পথ, অতিশয় দরারোহণীয় এবং দরবরোহণীয়, সচরাচর বসতিশন্য। কিন্তু এই দগম পথ প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছিল— এখন সমতল ভূমিতে অবরোহণ করতে হইবে। পথিকেবা এক অনিববিচনীয় শোভাময় অধিত্যিকায় প্রবেশ করিল। দই পাশে বা অনাতি-উচ্চ পৰ্ব্ববতদ্বয়, হরিত-বাক্ষাদিশোভিত। হইয়া আকাশে মাথা তুলিধাছে, উভয়ের মধ্যে কালনাদিনী ক্ষদ্রা প্রবাহিণী নীলকাচপ্রতিম সফেন জলপ্রবাহে উপলদল ধৌত করিয়া বনানীর অভিমতখে চলিতেছে। তটিনীর ধারা দিয়া মানষ্যেগম্য পথের রেখা পড়িয়াছে। সেখানে নামিলে, আব্ব কোন দিক হইতে কেহ পথিককে দেখিতে পায় না; কেবল পৰ্ব্ববতদ্বয়েৰ উপর হইতে দেখা খায়। সেই নিভৃত সংস্থানে অবরোহণ করিয়া, একজন বণিক, ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার ঠাই টাকা-কড়ি কি আছে ?” ব্রাহ্মণ প্রশন শনিয়া চমকিত ও ভীত হইলেন। ভাবিলেন, বা ঝি এখানে দস্যর বিশেষ ভয়, তাই সতকা করিবার জন্য বণিকেরা জিজ্ঞাসা করিতেছে। দািববলের অবলম্বন মিথ্যা কথা । ব্রাহ্মণ বলিলেন, “আমি ভিক্ষক ব্রাহ্মণ, আমার কাছে কি থাকিবে ?” বণিক বলিল, “যাহা কিহু থাকে, আমাদের নিকট দাও । নহিলে এখানে রাখিতে পরিবে না।” ব্রাহ্মণ ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। একবার মনে করিলেন, রত্নবলয় রক্ষাৰ্থ বণিক দিগকে দিই; আবার ভাবিলেন, ইহারা অপরিচিত, ইহাদিগকেই বা বিশ বাস কি ? এই ভাবিয়া ইতস্ততঃ করিয়া ব্ৰাহ্মণ পাকবািবং বললেন, “আমি ভিক্ষক, আমার কাছে কি থাকিবে ? “ বিপৎকালে যে ইতস্ততঃ করে, সেই মারা যায়। ব্রাহ্মণকে ইতস্ততঃ করিতে দেখিয়া ছদ্মবেশী বণিকেরা বঝিল যে, অবশ্য ব্রাহ্মণের কাছে বিশেষ কিছর আছে। একজন তৎক্ষণাৎ ব্রাহ্মণের ঘাড় ধরিয়া ফেলিয়া দিয়া তাঁহার বকে হাঁট দিয়া বসিল—এবং তাঁহার মাখে। হাত দিয়া চাপিয়া ধরিল। মিশ্র ঠাকুরের ভূত্যটি তৎক্ষণাৎ কোন দিকে পলায়ন করিল, কেহ দেখিতে পাইল না। V. SS