পাতা:বঙ্গদর্শন নবপর্যায় তৃতীয় খণ্ড.djvu/২০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চম সংখ্যা । ] - নৌকাডুবি। १०6t তাহার সকল দুশ্চিন্ত কুয়াশার মত কাটিয়া গেল। পৃথিবীতে কিছুর জন্তই যে কোনপ্রকার ভয়ভাবন হইতে পারে, তাহা তাহার মনেই হইল না । যাহাকে কিছুক্ষণ পূৰ্ব্বে হিমালয় মনে হইয়াছিল, সে তাহার পায়ের কাছে দেখিতে দেখিতে মেঘের মত হাল্কা হইয়া গেল—তাহার জীবনপথের সম্মুখে সমস্তই সহজ, স্বন্দর, স্বমঙ্গল বলিয়া বোধ হইল । সে চারিদিকে চাহিয়া মনে মনে কহিল, “হে মহাসুন্দর নিখিল বিশ্ব, আমি আপনাকে নিঃশেষে তোমার কাছে উৎসর্গ করিলাম।” আর সেই লজ্জিত পুলকিত মুখচ্ছবি বারবার স্মরণ করিয়া বলিতে লাগিল —“পৃথিবীর মাটির উপর দিয়া তোমাকে কেন চলিতে হয় – তোমার চলিবার পথে আমি আমার হৃদয় বিছাইয়া দিতে চাই ! তোমার প্রত্যেক পদক্ষেপ আমার ভালবাসার মধ্যে অনুভব করিলে তবে আমি কৃতার্থ হইতে পারি !” রমেশ যে গৎটা হেমনলিনীর কাছ হইতে হাৰ্ম্মোনিয়মে শিখিয়াছিল, বাসায় গিয়া সেইটে খুব করিয়া বাজাইতে লাগিল । কিন্তু একটিমাত্র গৎ সমস্তদিন বাজানে চলে না । কবিতার বই পড়িতে চেষ্টা করিল—মনে হইল, তাহার ভালবাসার স্বর যে স্থদুর উচ্চে উঠিতেছে, কোনো কবিতা সে পৰ্য্যন্ত নাগাল পাইতেছে না । অীর হেমনলিনী আশ্রাস্তু আনন্দের সহিত তাহার গৃহকৰ্ম্ম সমস্ত সারিয়া নিভৃত দ্বিপ্রহরে শয়নঘরের দ্বার বন্ধ করিয়া তাহার সেলাইটি লইয়া বসিয়াছে। মুখের উপরে একটি পরিপূর্ণ প্রসন্নতার শাস্তি । একটি সৰ্ব্বাঙ্গীণ সার্থকতা তাহাকে জননীর মত স্নিগ্ধব হুপাশে বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে—আজি তাহার অস্তরেবাহিরে কোথাও কিছুমাত্র শূন্তত নাই, তাহার আনন্দের মধ্যে কোথাও অবকাশ নাই। ইতিপূৰ্ব্বে, কথন রমেশ আসিবে, কখন চায়ের সময় হইবে, কখন ছাদে যাইবে, ইহ লইয়া হেমনলিনীর চিত্ত সমস্তদিন উৎসুক হইয়া থাকিত, আজ তাহার আর সে চঞ্চলত নাই। আজ তাহার আর ভিক্ষুকভাব নহে—তাহার হৃদয়ের শেষসীমা পর্য্যস্ত ভরিয়া আজি সুধা সঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছে— প্রেমের যজ্ঞে প্রিয়জনের হস্তে তাহ সম্পূর্ণ সমপণ করিবার জন্ত সে আজ একান্তমনে অৰ্ঘ্যধারিণী পূজার্থিনীর মত নীরবে অপেক্ষ করিয়া আছে । চায়ের সময়ের পূৰ্ব্বেই কবিতার বই এবং হাৰ্ম্মোনিয়ম ফেলিয়া রমেশ অন্নদণবাবুর বাসায় অগসিয়া উপস্থিত হইল । অন্তদিন হেমনলিনীর সহিত দেখা হইতে বড় বিলম্ব হইত না । কিন্তু আজি চায়ের ঘরে দেখিল সে ঘর শূন্ত, দোতলায় বসিবার ঘরে দেখিল সে ঘরও শূন্ত, হেমনলিনী এখনো তাহার শয়নগৃহ ছাড়িয়া নামে নাই । অন্নদাবাবু যথাসময়ে আসিয়া টেবিল অধিকার করিয়া বসিলেন, এবং নানা বিষয়ে, বিশেষত স্বাস্থ্যতত্ত্বসম্বন্ধে উপদেশপুর্ণ সুদীর্ঘ আলোচনা করিতে লাগিলেন । রমেশ নিরীহের মত কদাচিৎ তাহার দুটা-একটা উত্তর দিল এবং ক্ষণে ক্ষণে চকিতভাবে দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল । পদশব্দ হইল, কিন্তু ঘরে প্রবেশ করিল অক্ষয় । যথেষ্ট হৃদ্যতা দেখাইয়া কহিল—