পাতা:বঙ্গদর্শন নবপর্যায় দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Y9 বঙ্গদর্শন । সমস্ত জীবন খৰ্ব্ব ও নানাদিকে খণ্ডিত হইয়াছিল, সেই কয়দিনকে সে তাহার নির্জনবাসের কল্পনাস্ত,পের গভীর তলে সমাধি দিয়া ভুলিয়া ছিল। কাব্য উপন্যাসসাহিত্যের বেড়া দিয়া, পল্লীর ভিতরে থাকিয়া ও সে একটি নিভৃত কল্পনা-লোক স্বজন করিয়া লইয়াছিল। বিনোদিনী এবার যখন যাত্রিশূন্ত মেয়েদের গাড়িতে চড়িয়া বাতায়ন হইতে চষামাঠ ও ছায়াবেষ্টিত একএকখানি গ্রাম দেখিতে পাইল, তখন তাহীর মনে সেই স্নিগ্ধনিভূত পল্লীর জীবনযাত্র জাগিয়া উঠিল। সেই তরুচ্ছায়াবেষ্টনের মধ্যে তাহার স্বরচিত কল্পনানীড়ে নিজের প্রিয় বইগুলি লইয়া কিছুকাল নগরবাসের সমস্ত ক্ষোভ, দাহ ও ক্ষতবেদনা হইতে সে যে শান্তিলাভ করিতে পরিবে, এই কথা তাহীর মনে হইতে লাগিল। গ্রীষ্মের শস্যশূন্ত দিগন্তপ্রসারিত ধূসর মাঠের মধ্যে স্বৰ্য্যাস্তদৃশ্য দেখিয়া বিনোদিনী ভাবিতে লাগিল—আর যেন কিছুর দরকার নাই—মন যেন এইরূপ সুবর্ণরঞ্জিত স্তব্ধ-বিস্তীর্ণ শাস্তির মধ্যে সমস্ত ভুলিয়া দুই চক্ষু মুদ্রিত করিতে চায় – তরঙ্গবিস্কুদ্ধ সুখদুঃখসাগর হইতে জীবনতরিটি তীরে ভিড়াইয়া নিঃশব সন্ধ্যায় একটি নিষ্কম্প বটবৃক্ষের তলায় বাধিয়া রাখিতে চায়—আর কিছুতেই কোন প্রয়োজন নাই। গাড়ি চলিতে চলিতে এক-এক জায়গায় আম্রকুঞ্জ হইতে মুকুলের গন্ধ আসিতেই পল্লীর স্নিগ্ধশান্তি তাহাকে নিবিড়ভাবে আবিষ্ট করিয়া তুলিল। মনে মনে সে কহিল, “বেশ হইয়াছে, ভালই হইয়াছে ; নিজেকে [ বৈশাখ লইয়। আর টানাছোঁড়া করিতে পারি না— এবারে সমস্ত ভুলিব, ঘুমাইব,—পাড়াগায়ের মেয়ে হইয়া ঘরের ও পল্লীর কাজে-কৰ্ম্মে সন্তোষের সঙ্গে, আরামের সঙ্গে জীবন কাটাইয়া দিব ।” তৃষিত বক্ষে এই" শাস্তির আশি বচ্চন করিয়া বিনোদিনী আপনার কুটীরের মধ্যে প্রবেশ করিল। কিন্তু হায় শাস্তি কোথায় ! কেবল শূন্যতা এবং দারিদ্র্য ! চারিদিকেই সমস্ত জীর্ণ, অপরিচ্ছন্ন, অনাদৃত, মলিন । বহুদিনের রুদ্ধ স্ত"াৎসে’তে ঘরের বাম্পে তাহার যেন নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আসিল । ঘরে অল্পস্বল্প যে সমস্ত আসবাবপত্র ছিল, তাহা কীটের দংশনে, ইদুরের উৎপাতে ও ধূলার আক্রমণে ছারখার হইয়া আসিয়াছে । সন্ধ্যার সময় বিনোদিনী ঘরে গিয়া পৌছিল—ঘর নিরানন্দ, অন্ধকার। কোন মতে সর্যের তেলে প্রদীপ জালাইতেই তাহার ধোয়ায় ও ক্ষীণ আলোতে ঘরের দীনতা আরো পরিস্ফুট হইল। আগে যাহা তাহাকে পীড়ন করিত না, এখন তাহা অসহ বোধ হইতে লাগিল—তাহার সমস্ত বিদ্রোহী অস্তঃকরণ সবলে বলিয়া উঠিল, “এখানে ত একমুহূৰ্ত্তও কাটিবে না। কুলুঙ্গিতে পূৰ্ব্বেকার দুই-একটা ধূলায় আচ্ছন্ন বই ও মাসিকপত্র পড়িয়া আছে, কিন্তু তাহা ছুইতে ইচ্ছা হইল না। বাহিরে বায়ুসম্পর্কশূন্ত আমিবাগানে ঝিল্লী ও মশার গুঞ্জনস্বর অন্ধকারে ধ্বনিত হইতে লাগিল । বিনোদিনীর যে বৃদ্ধ অভিভাবিক। ছিলেন, তিনি ঘরে তাল লাগাইয় মেয়েকে দেখিতে সুদুরে জামাইবাড়ীতে গিয়াছেন।