পাতা:বঙ্গভাষা ও সাহিত্য - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

& S 0 বঙ্গভাষা ও সাহিত্য চণ্ডীদাসকে আমরা এ পৰ্য্যন্ত যাহা মনে করিয়া আসিয়াছি, কৃষ্ণকীৰ্ত্তনে সেই ধারণা কতকটা ক্ষুন্ন হইবার কথা । তিনি প্রেমের যে উচ্চ গ্রামে সুর বঁাধিয়াছেন,-কৃষ্ণকীৰ্ত্তন যে তাহার आनक নিয়ে। এ পাড়াগােঁয়ে কৃষক-কবির অকপট লালসার কথায় সে আধ্যাত্মিক সৌন্দৰ্য্য কোথায় ? এ যে গ্ৰাম্য ব্যভিচারী প্রেমের শীলতাশূন্য আবৰ্জনা ; এখানে সে ব্যোমস্পর্শী পবিত্ৰত কোথায় ? চণ্ডীদাস বলিতে আমরা যে পবিত্রতা ও যুথিকা শুভ্ৰ নিৰ্ম্মলতা বুঝি, এখানে তাহা নাই। এ যে একান্ত স্কুল, একান্ত বিসদৃশ চিত্র-পট, আঁধারে ছিল—ভাল ছিল, চণ্ডীদাসকে যে এই কীৰ্ত্তন হেয়, অশ্রদ্ধেয় করিয়া দিল ; তঁাহার পদাবলীর সঙ্গে এক পংক্তিতে কৃষ্ণকীৰ্ত্তন রাখা যায় না। তাহা হইলে যে ব্ৰহ্মচণ্ডাল যোগ হয়। *- ܃ দ্বাদশ হইতে চতুৰ্দশ শতাব্দী পৰ্য্যন্ত বঙ্গ ও উড়িষ্যার এক অতিশয় নৈতিক দুৰ্গতির দিন উপস্থিত হইয়াছিল। জয়দেবের গীত-গোবিন্দের আধ্যাত্মিকতা যাহাঁই থাকুক না কেন, তাহার রুচি প্ৰত্যেক পাঠকের চক্ষে পড়িবে ; জীবনেও পদ্মাবতী নামী এক “সেবাদাসী৷” তঁাহার সঙ্গিনী ছিলেন, সেকশুভোদয় গ্রন্থে আভাস পাওয়া যায় যে, পদ্মাবতী লক্ষ্মণসেনের সভায় নৃত্য করিতেন। বনমালী দাসের জয়দেব-চরিতে স্পষ্ট লিখিত আছে, এই রমণী পুরীর মন্দিরে সমৰ্পিত হইয়াছিলেন। পদ্মাবতী চরণ চারণ চক্ৰবৰ্ত্তী” পদেও দৃষ্ট হয়, ইনি নৃত্য করিতেন এবং জয়দেব তাহার তাল রক্ষা করিতেন। এই জন্যই জয়দেব “নবরসিকে”র একজন, বিবাহিত পত্নী দ্বারা সে উপাধি লাভ ঘটিত না। দ্বাদশ শতাব্দীর তাম্রশাসনগুলিতে এই ভাবের পর-রমণীর প্রতি আসক্তির জয়-গীতিকা ঘোষিত হইয়াছে। লক্ষ্মণসেন কলিঙ্গ-রমণীগণের প্ৰেম লাভ করিয়াছিলেন, এজন্য এক তাম্রশাসনের কবি তাহাকে প্ৰশংসা পত্ৰ দিয়াছেন, ধোয়ী কবির পবনদূতে তিনি এই ভাবের দ্বিতীয় একখানি প্ৰশংসাপত্ৰ পাইয়াছেন। এই যুগের তাম্রশাসনগুলিতে হর পাৰ্বতী বন্দনায়, তাহাদের হাব-ভাব ও পরস্পরের আলিঙ্গন বদ্ধ প্ৰেম-লীলা যে ভাবে বর্ণিত হইয়াছে।--তাহা শীলতার অভাব ও রুচির বিকার সুচনা করিতেছে। সাহিত্য পরিষদে চিত্রশালায় হরপার্বতীর সেই সময়কার একখানি বীভৎস প্রস্তরমূৰ্ত্তি আছে। পুরী ও কোণার্ক মন্দিরের গাত্রে ক্ষোদিত মূৰ্ত্তি সমূহের দিকে চাহিতে চক্ষু লজ্জায় অবনত হইয়া পড়ে। দ্বাদশ শতাব্দীতে তন্ত্রাদির বিশেষ অনুশীলনের ফলে স্ত্রীপুরুষের মধ্যে শীলতা ও সংযম অনেকটা হ্রাস পাইয়াছিল। রাজসভায় যে ভাব-বিকার উপস্থিত হয়, সমাজের নিম্নস্তরে তাহা যখন আসিয়া পৌঁছায়, -তখন তাহা অতি বিকট হয়। সুতরাং দ্বাদশ শতাব্দীব্য পরে বঙ্গদেশের জনসাধারণের মধ্যে অতি ঘোর রুচিবিকার দেখা গিয়াছিল। আমার ধারণা যে, সেন বংশের পতনের পর কামরূপ ও মিথিলী এই দুই কেন্দ্ৰ হইতে রুচির ধারা সমস্ত বঙ্গদেশে আসিয়া ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। ।