পাতা:বঙ্গভাষা ও সাহিত্য - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৬৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নবম অধ্যায়ের পরিশিষ্ট (93) র্তাহার কেনই দ্বিধা রহিল না। শুধু স্বপ্ন নহে, মানুষের কথা-বাৰ্ত্ত হইতে অতর্কে উচ্চারিত দুই একটি কথার মধ্যে তিনি যিশুর আদেশ বুঝিয়া ফেলিতেন। একদিন কোন গুরুতর বিষয়ে চিঠি লিখিয়া তাহা ডাকে ফেলিতে যাইবেন, এমন সময় পার্শ্ববৰ্ত্তী খালে মাঝিদের কথা-বাৰ্ত্তা তাহার কর্ণগোচর হইল। টমাস বাঙ্গলা শিখিয়াছিলেন—তিনি শুনিলেন এক মাঝি আর এক মাঝিকে বলিতেছে, “জমিদার মারে-কাল যাবে।” এই অনির্দিষ্ট বাক্য র্তাহাকে স্পষ্ট করিয়া যিশুর কি একটা আদেশ বুঝাইল। তিনি চিঠিখানি ছিড়িয়া ফেলিলেন এবং সেই মাঝির উক্তিতে প্ৰভু তঁহাকে যাহা বুঝাইয়াছিলেন, তদনুসারে নূতন এক চিঠির খসড়া প্ৰস্তুত করিলেন। শঠের পাল্লায় । “এমন লোককে প্রতারণা করা খুব সহজ। কেউ যদি তঁহাকে আসিয়া বলিত “মহাশয়, প্ৰভু যিশু ভিন্ন আমার আর গতি নাই”, কিংবা কোন স্বপ্নের উল্লেখ করিত-তবে টমাস ভক্তিতে গলিয়া যাইতেন এবং জানু পাতিয়া বসিয়া গলদশ্রীচক্ষে খুষ্টের মহিমা স্মরণ করিতেন। তিনটি বাঙ্গালী ভদ্রলোক টমাসের এই দুর্বলতা বুঝিতে পারিয়া তাহা তাহদের সুবিধায় লাগাইয়া দিল । একদিন পর্বতীচরণ মুখোপাধ্যায় রাত্রি দুইটার সময় কঁাদিয়া আকাশ ফাটাইল, এবং তাহার হাত ধরিয়া বদনচন্দ্র অধিকারী কেবলই জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, “বল কি হইয়াছে ?” বহু জিজ্ঞাসার পর মুখুজ্য বলিল, “ঈশ্বরের দূত স্বরূপ টমাস পাদ্রীকে প্রত্যাখ্যান করিয়া কি কুকৰ্ম্মই না করিয়াছি। আমি স্বপ্নে দেখিলাম যেন নরকাগ্নি দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতেছে- এবং তাহা আমাকে অনুসরণ করিয়া ছুটিতেছে, এ সময়ে ঈশ্বরের একমাত্র জাত-সন্তান যিশু ভিন্ন কে আমাকে রক্ষা করিবে ?” এই কথা শুনিয়া বদন অধিকারীর চক্ষুও অনাৰ্দ্ধ রহিল না,-দুই জনে হাউ মাউ করিয়া কঁাদিয়া পাদ্রীধামে উপস্থিত হইল। পাদ্রীর সরল চক্ষের জল, ঐ দুই ব্যক্তির কপটাশ্রীর সঙ্গে মিশিয়া বিষামৃতের সৃষ্টি করিল। টমাস তদবধি এই দুই জনের বৃহৎ পরিবার প্রতিপালনের ভার নিজে লাইলেন, এবং তাহাদিগকে ঋণমুক্ত করিতে যাইয়া নিজে এরূপই ঋণজালে আবদ্ধ হইয়া পড়িলেন যে, একবার তাহার নামে ওয়ারেন্ট বাহির হইল এবং দ্বিতীয় বার বিলাত হইতে রওনা হইবার সময় তাহার উত্তমণি তঁহাকে গ্রেপ্তার করিয়া জাহাজ হইতে নামাইয়া লইয়া আসিল। অথচ প্ৰকাশ্যে খৃষ্টর নাম শুনিয়া দুটি বাঙ্গালী বন্ধুর দেহ যতই কণ্টকিত হউক না কেন, খৃষ্টধৰ্ম্মে দীক্ষাগ্ৰহণের প্রস্তাব হইলে নানা ওজুহাতে তাহারা দিন পিছাইয়া দিতে লাগিল। মূল কথা, তাহারা পাদ্রীদের খরচায় দুর্গোৎসব, দোলযাত্রা প্রভৃতি পালন করিয়া চিরকালই মহাসুখে দিন গুজরাণ করিয়াছে, কোন কালেই খৃষ্টান হয় নাই।